টুসু পরব –একটি যথার্থ হৃদয়ের উৎসব
পশ্চিম বাংলা এখন উৎসবময় । নানা ছুতোয় নানান রকমের উৎসব হচ্ছে সরকারী উদ্যমে । হটাৎ করে যেন আমাদের শিকড় বড়বেশি করে টানতে আরম্ভ করেছে । বর্ষা বসন্ত জল মাটি , নবান্ন ,অমুক ষষ্টি , তমুক সক্ক্রান্তি এ সব কে আরবানাইসড করে এক ধরণের উৎসবের হুজুগ লেগে গেছে । গতকাল যে পৌষ সঙ্ক্রান্তি গেল সেটা আমরা পিঠে পরব বলেই জানি । বাড়িতে পিঠে হোক না হোক মিষ্টির দোকানে কিছু বিশেষ পিঠের চুটিয়ে বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু শহুরে মানুষদের কজনই বা খোঁজ রাখেন এ দিনটি টুসু পরব বলে রাড় বাংলার মাটর সঙ্গে জুড়ে থাকা মানুষদের একটি হৃদয়ের উৎসব ।
‘আমাদের’ বলতে এই আমরা যারা নিজেদের ভদ্রলোক শ্রেণির মধ্যে পড়ি বলে মনে করি তাদের ‘টুসু ’ নামে কোনো আরাধ্য দেবী নেই । এক মাস ধরে এই রাঢ় বাংলার, বিশেষ করে মানভুম অঞ্চলে পূজিত হবার পরে মকর সংক্রান্তির দিন যে টুসু প্রতিমাকে কে খড়কাই , সুবর্নরেখা , কাঁসাই , গেঁদাই , শীলাই নদীতে বিসর্জন দেওয়া হবে তার সঙ্গে আমাদের তথাকথিত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সম্পর্ক আমরা তেমন করে স্বীকার করি না । সুরেন্দ্র মোহন ভট্টাচার্য মহাশয় রচিত সাম , যজু ও ঋক বেদের থেকে সংগৃহীত সর্ব প্রকার পূজাপাঠের যে একমাত্র ম্যানুয়ালটি পাওয়া যায় তাতে এই টুসু পূজার জন্যে কোনো মন্ত্র নির্দিষ্ট করা নেই ।
কারন টুসু উৎসব এক অবৈদিক, অস্মার্ত, অপৌরাণিক এবং অব্রাহ্মণ্য উৎসব। আমাদের পাঁজীতে এ উৎসবের নির্ঘন্ট দেওয়া থাকে না ।
টুসু এক কুমারী কন্যা । এর পূজাও করেন কুমারী কন্যারা ।আমরা যাদের নিম্নবর্গের মানুষ বলি সেই তাদের বাড়ির কুমারী কন্যারা । কিন্তু এ পূজার কোনো মন্ত্র তন্ত্র , নেই নির্ধারিত ক্রিয়া-কর্ম , কোনো বিশেষ উপাচারও নেই । অঘ্রান মাসের শেষ দিন থেকে পৌষ মাসের শেষ দিন অবধি রাঢ় বাংলার প্রত্যন্ত গ্রামে গ্রামে এই টুসু পুজিত হন ।যে হেতু মন্ত্র তন্ত্র নেই , তাই এ পূজায় কোনো ব্রাহ্মনের প্রয়োজন হয় না । সন্ধ্যাবেলায় গ্রামের ‘অশিক্ষিত’ মেয়েরা নিজেদের সাজানো রঙিন কাগজের চৌদলের উপর প্রতিষ্ঠিতা পোড়ামাটির টুসুর মূর্তির সামনে বসে নানা রকমের গান বাঁধেন আর সেই গান করেন কখনো সম্মিলিত কখনো একক কণ্ঠে । সে গানে টুসুর মহিমা কীর্তন শুধু নয় , থাকে তাদের যাপিত জীবনের সাধ আহ্লাদ , আশা নিরাশা , ঠাট্টা তামাশার কথা । এবং তাতে ছায়া ফেলে তাদের ঘিরে থাকা আধুনিক সময় , এবং তাদের গাঁ-ঘরের পারিপার্শ্বিক । কখনো থাকে ক্ষোভ প্রতিবাদ , কখনো থাকে দুঃখ বিষাদ ।এক মাস ধরে এই মন্ত্রহীন পুজার শেষে মকর সংক্রান্তির দিন ব্যাথিত হৃদয়ে তাদের ঘরের মেয়ের প্রাণের প্রতিমা কে তারা বিসর্জন দিয়ে আসে তাদের কাছের কোনো এক নদী অথবা পুকুরে । ফুল বেলপাতা নয় , ধানের তুষ দিয়ে এ পূজার ডালি সাজানো হয় বলে সম্ভবত এই দেবীর নাম টুসু হয়েছে ।
কোল, মুন্ডা, ওরাওঁ, সাঁওতাল, মুন্ডা, ভূমিজ, ভুঁইয়া, কুর্মি, মাহাতো ,বাউরী বাগদী মহিলারা এই পূজো করেন । কিন্তু আশ্চর্য লাগে এই ভেবে গোটা পূজার্চনার ব্যাপারটা পরিচালিত হয় এই শ্রেনীর মহিলাদের দ্বারা আর এই উৎসবের প্রধান আকর্ষন এই মেয়েদের তাৎক্ষনিক ভাবে রচিত রচিত গান । নতুন ফসল ঘরে আসার খুশি উদযাপনের এর চেয়ে সুন্দর রুপ য়ার কি বা হতে পারে ।
এ তাদের প্রাণের গানের ভাষা আর সে গানে কখনো তাদের টুসু একেবারে আটপৌরে মেয়ে , তাদেরই মতন -
‘টুসু সিনাচ্ছেন , গা দলাচ্ছেন
হাতে তেলের বাটি
নয়ে নয়ে চুল ঝাড়ছেন
গলায় সোনার কাঠি...’
আবার কখনো তাকে নিয়ে গ্রাম্য কোন্দল -
আমার টুসু মুড়ি ভাজে, চুড়ি ঝনঝন করে গো
উয়ার টুসু হ্যাংলা মাগি, আঁচল পাইত্যে মাগে গো।
গাঁয়ের মেয়ে যখন শহরে চলে যায় লেখা পড়া শিখতে তখন সে কিছুটা শহুরে হয়ে যায় , হয়তো তার গ্রামের প্রতি টান কমে যায় , তেমনি একটা অভিমানের জায়গা থেকে গান বেরিয়ে আসে -
‘না রহিবেন গাঁয়ে টুসু যাবেন ইবার শহরকে
আলতা চরন জুতায় ঢেকে দিবে না পা ডহর কে
গীত গাহিবেন অবাক কলে , পান কিনিবেন দোকান লে
বছর বছর সাধ জাগিলে আসতে পারেন উখান লে
গঙ্গা সিনান , সিনেমা টকি , গড়ের মাঠ আর কালিঘাট
বতর পাইলে লেখাপড়ায় হরেক কিসিম লিবেন পাঠ ‘
আবার টুসু যেন তাদের প্রিয় সখী , তাকে নিয়ে বেড়াতে যাওয়ার আহ্বান -
‘চল টুসু খেলতে যাবো রানীগঞ্জের বটতলা
অমনি পথে দেখাই আইনব কয়লাখাদের জল তুলা
উলোট পালট ফুলুট বাঁশিতে
আমার মন মানে না ঘরেতে ...’
আবার এ গানেরই শেষের লাইনে সেই জীবিকার সন্ধানে গ্রাম ছেড়ে শহরে যাওয়ার ব্যাথা, টুসুর কাছে কিন্তু কোনো চাওয়া নেই ,রুপং দেহি , ধনং দেহি নেই , জমিতে ধান না হওয়ার জন্যে কোনো অভিযোগ নেই , বরং তাকে সঙ্গী করেই চলুক জীবন সংগ্রাম –
‘ চল টুসু চল টাটা যাবো
ধান হইল না কি খাবো ’
আবার সেই টুসু কে, পৌষ মাসের সংক্রান্তির দিন বিদায় দিতে হবে , এক মাস ধরে সে ঘরে ছিল । তার সঙ্গে মনের প্রাণের কথা হয়েছে , তাই তাকে বিদায় বেলার মালা খানি , গান দিয়েই পরিয়ে দেওয়া –
আমার টুসু ধনে
বিদায় দিব কেমনে
মাসাবধি টুসুধন কে
পুজ্যাছি যতনে ।
শাঁখা সাড়ি সিঁদুর দিলাম
আলতা দিলাম চরনে ।
মনে দুঃখু হয় বড়
ফিরে যেতে ভবনে
দয়া কইরে আসবে আবার
থাকে যেন মনে
ভুইলনা ভুইলনা টুসু
আসবে আমার সনে ।
আমরা নবমী নিশি শেষে দুর্গার বাপের বাড়ি ছেড়ে স্বামীর বাড়িতে ফিরে যাওয়ার ব্যাথা নিয়ে অনেক গান শুনেছি , কবিতা পড়েছি । সে গান বা কবিতা হয়তো অনেক পরিশীলিত । ছন্দের বাঁধুনী অনেক মজবুত , গান অনেক সুরেলা । তবে ভাবনায় এই টুসুর গানেরই সমগোত্রীয় । সেই একই আবেদন - পুনরাগমনায়চ-স্থাপিতাসী জলে ম্বয়া ।
মাঝে মাঝে ভাবি বিপুলা এ পৃথিবী তো দূরের কথা এই ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া – বাংলা দেশ টাকেই বা কতটুকু চিনলাম ।
পুরুলিয়া , বাঁকুড়া জেলার বাড়িতে বাড়িতে যে কতকাল ধরে টূসু পরব হয়ে আসছে , মকর সঙ্ক্রান্তির দিন মেলা বসে আসছে পরকুল, পরেশনাথ, কেচন্দা, লক্মীসাগর, বীরপাট ও সুইসা ও মানবাজার কাশীপুর, হুড়া, ঝালদা, বলরামপুর, তালতলায়, তার খবর আমরা ক জনই বা রাখি । আমাদের দৌড় তো ওই সৌখিন বইমেলা বা পৌষমেলা অবধি ।
যখন আমরা পাঁজী পুঁথি দেখে আমাদের চেনা দেব দেবীর পুজো করি , তখন ভয়ে হোক আর ভক্তিতে হোক আমাদের থাকে একশো ভাগ নিয়ম-নিষ্ঠা , আর চেষ্টা করি সেই হাজার হাজার বছর আগে রচিত বেদে যে মন্ত্র বলা আছে তা যেন যথাবিহিত উচ্চারিত হয় । যে মানুষ টি ভক্তি ভরে পুজায় অংশ নিচ্ছে তার কাছে সে মন্ত্র বোধ্যই হোক আর অবোধ্যই হোক , তার সঙ্গে আমাদের আজকের জীবনের যোগ থাক অথবা নাই থাক ।
কিন্তু এই যে টুসু পুজোর গান , এখানে ওরা নির্ভয়ে আজকের জীবনের সুখ দুঃখের কথা শোনান তাদের আরাধ্য দেবীর কাছে ।
আমাদের বোধহয় নতুন করে ভাবা দরকার কারা বেশি আধুনিক আমরা না ওরা !
এই মাটি আঁকড়ে পড়ে থাকা জীবনের দর্শন , এই সরলতায় সম্বৃদ্ধ গান , যা শুনে বার বার মনে হয় –
...সে গানে বিদ্ধ বুক রক্তে অশ্রু ছল ছল
এ যদি আমার দেশ না হয় তো কার দেশ বল ?
আর ভাবতে ভালো লাগে আর কেও না হোক রবীন্দ্রনাথ স্বীকৃতি দিয়েছেন এই আমাদের সাহিত্য সংস্কৃতির এই ‘নিম্ন- অংশ ’ টিকে -
‘গাছের শিকড়টা যেমন মাটির সঙ্গে জড়িত এবং তাহার অগ্রভাগ আকাশের দিকে ছড়াইয়া পড়িয়াছে, তেমনি সর্বত্রই সাহিত্যের নিম্ন-অংশ স্বদেশের মাটির মধ্যেই অনেক পরিমাণে জড়িত হইয়া ঢাকা থাকে; তাহা বিশেষরূপে সংকীর্ণরূপে দেশীয়, স্থানীয়। তাহা কেবল দেশের জনসাধারণেরই উপভোগ্য ও আয়ত্তগম্য, সেখানে বাহিরের লোক প্রবেশের অধিকার পায় না। সাহিত্যের যে অংশ সার্বভৌমিক তাহা এই প্রাদেশিক নিম্নস্তরের থাক্'টার উপরে দাঁড়াইয়া আছে। ’
আচ্ছা, এই যে ওদের আরাধ্য দেবী কে ঘিরে, চলমান জীবন থেকে উপকরন নিয়ে নির্বিশেষ মানুষদের গান বাঁধার উৎসব, আর সেই সুযোগে আরো একটু সবাই মিলে বেঁধে বেঁধে থাকার চেষ্টা , এমন উৎসব আমাদের , মানে যারা তথাকথিত ‘উচ্চ বর্গ’র মানুষ , তাদের নেই কেন ?বোধহয় আমরা সেই অকৃত্তিম সরলতা টা হারিয়ে এসেছি সভ্যতার রাজপথ দিয়ে এগিয়ে যেতে যেতে ।
আপনার রচনাতে টুসু পূজার সামাজিক অবস্থানের চিত্রটি মূর্ত হয়েছে, আমার বিশেষ ভাল লেগেছে।

আরো পড়ুন
- 1