তোমারি তুলনা তুমি -২
তোমারি তুলনা তুমি -২
**********************
‘কবিরে পাবেনা তার জীবন চরিতে’ এমন একটি সাবধান বাণী লিখে রবীন্দ্রনাথ আমাদের সবাইকে কোনো কবির ব্যাক্তিগত জীবনের প্রতি অতি ঔৎসুক্য থেকে সংযত থাকতে বলেছিলেন । কিন্তু আমাদের উৎসাহ তাতে বিন্দুমাত্র কমেনি । প্রিয় কবির জীবনযাপনের ব্যাক্তিগত খুটি নাটি জানবার ইচ্ছেতে কোনো দিন ভাটা পড়েনি । তার প্রমান ‘কাদম্বরী দেবীর সুইসাইড নোট’ নামে একটি বই বহুদিন ধরে বেস্ট সেলার হয়ে আছে । যারা পাঠ্য পুস্তকের বাইরে রবীন্দ্রনাথের কোনো বইই পড়েননি তারাও বোধহয় পড়ে ফেলেছেন এই বইটি । তার কারণটা আর নাই বা বললাম। বাঙালি শিলং এ বেড়াতে গিয়ে আজও খোঁজে লাবণ্যর সেই বাড়িটি । নীরা, যার মন খারাপ হলে কোলকাতায় ট্রাফিক জ্যাম হয়ে যায় , সে কোলকাতার কোন পাড়ায় বাস করতো এ নিয়ে তর্ক আজও চলে ।
আর একটি ছোট্টো মফস্বল শহর যে বাঙালি কাছে কি ভাবে চিরকালের আগ্রহের জায়গা হয়ে রয়ে যেতে পারে তা তো আমরা জানি । শহরের নাম নাটোর । যেখানে বনলতা সেন থাকতেন । হাজার বছর পথ হাঁটার পর বাঙালি বোধহয় ভুলবেনা বনলতা সেন কে । অনেকে ভাবেন এই একটি কবিতা লিখলেই জীবনানন্দ বাংলা সাহিত্যে অমর হয়ে থাকতেন । কিন্তু একটি সত্য আমরা এখন জানতে পেরেছি ( দেবী প্রসাদ বন্দোপাধ্যায়ের সৌজন্যে) হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে – এই লাইনটি কবিতার প্রথম খসড়াতে ছিলই না । কবিতাটি শুরু হয়েছিল এ ভাবে – জীবনের সব লেন দেন / বনলতা সেন ।
আর শেষ হয়েছিল –
‘কত যে ঘুমিয়ে রব বস্তির পাশে
কত যে চমকে জেগে উঠিব বাতাসে
হিজল জামের বনে থেমেছে স্টেশনে বুঝি রাত্রি নিশুথির বনলতা সেন ।’
নিঃসন্দেহে প্রথম খসড়ার চেয়ে যে কবিতা আমাদের মুখে মুখে ফেরে সেটি অনেক বেশি সুন্দর ।
কথা হচ্ছিল জীবন চরিত নিয়ে । মানুষ জীবনানন্দ কে যারা কাছ থেকে দেখেছেন তাদের খণ্ডিত স্মৃতি চারণ থেকে একটু বুঝে নেবার চেষ্টা করা যাক কবিকে ।
বাবা সত্যানন্দ দাশ ছিলেন একজন শিক্ষাব্রতী আর মা ছিলেন সেকালের একজন নামকরা কবি – কুসুমকুমারী দাশ । বরিশালের ব্রজমোহন বিদ্যালয় তাঁর প্রথম স্কুল । এখান থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করে ভর্তি হন ব্রজমোহন কলেজে । সেখান থেকে প্রথম বিভাগে আই এ পাশ করে চলে আসেন প্রেসিডেসি কলেজে । ১৯২১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হাই সেকন্ড ডিভিশনে । পরীক্ষার আগে তিনি ব্যাসিলাস ডিসেন্ট্রিতে খুব ভুগেছিলেন ।
ইচ্ছে ছিল সে বছর পরীক্ষা ড্রপ দেওয়ার । কিন্তু মায়ের জোরাজুরিতে পরীক্ষা দিতে বাধ্য হন ।
মায়ের কথা তিনি কিছুতেই ফেলতে পারতেন না । বাবার সঙ্গে একটা সম্ভ্রমের দুরত্ব বজায় রাখতেন। কিন্তু মায়ের সঙ্গে সব কথা হত । কোনো দিন মায়ের সঙ্গে কবিতা নিয়ে কোনো আলোচনা হত কিনা তা অবশ্য আমরা জানতে পারিনা । কুসুমকুমারীর কবিখ্যাতি কিন্তু সে সময় কিছু কম ছিল না । ‘প্রবাসী’ আর ‘মুকুল’ পত্রিকায় তাঁর বেশ কিছু কবিতা ছাপা হয়েছিল । আর একটি কবিতার তো আমাদের কাছে প্রায় প্রবাদ প্রতীম হয়ে গেছে –
আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে
কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে ?
মুখে হাসি বুকে বল তেজে ভরা মন
মানুষ হইতে হবে এই তার পণ ---
জীবনানন্দ অবশ্য প্রথম থেকেই এই জাতীয় কবিতা থেকে অনেক দুরের যাত্রী । এম এ পাশ করে চাকরী পান সিটি কলেজে ।সে কলেজে ব্রাহ্মদের রমরমা ।ছাত্রদের সরস্বতী পুজো করা নিয়ে পরিচালন সমিতির একটি বিরোধ বাধে এবং তাতে ছাত্রদের সমর্থন করার অপরাধে জীবনানন্দের চাকরী যায় । তার পরে চাকরী করতে যেতে হয় তাঁর সাধের রুপসী বাংলা ছেড়ে দিল্লী তে রামযশ কলেজে ।সুদুর দিল্লীতে হয়ত খুব একাকীত্ব বোধ করছিলেন ।
মাথায় উঁকি দিচ্ছিল সেই বিখ্যাত লাইন গুলি –
‘...সকল লোকের মাঝে বসে
আমার নিজের মুদ্রা দোষে
আমি একা হতেছি আলাদা
আমার চোখেই শুধু ধাঁদা
আমার পথেই শুধু বাধা...।’
অনুভব করেছিলেন বাস্তব জীবনে একজন জীবন সঙ্গিনীর প্রয়োজনীয়তার কথা । তেমন কেও এলে কেটে যাবে একাকীত্ব ।এমনটাই ভেবেছিলেন হয়ত ।
সেই ভেবেই লাবণ্য গুপ্ত কে দেখতে এলেন জীবনানন্দ , লাবণ্যর জেঠামশাইয়ের ঢাকার বাড়িতে । লাবণ্য তখন ঢাকার ইডেন কলেজে হোস্টেলে থেকে আই এ পড়েন । সে কালের নিরিখে যথেষ্ট প্রগতীশীল । সুন্দরী এবং সপ্রতিভ ।
ব্রাহ্ম পরিবারের রীতিনীতি বেশ খোলা মেলা ছিল । জেঠামশাই জীবনানন্দ কে পাত্রী কে একান্তে প্রশ্ন করার সুযোগ দিলেন ।
গত তিন প্রজন্মের বাংলা ভাষাভাষী কবিযশপ্রার্থীরা যে জীবনানন্দের কবিতায় খুঁজে পান রোমান্টিকতার আশ্রয় , তিনি মানুষটি কি আদতে রোমান্টিক ছিলেন ?
তাঁর জীবনে যে নারী প্রথম আসতে চলেছে তাকে তাঁর করা প্রশ্ন গুলি জেনে তার কিছুটা আঁচ পাওয়া যেতে পারে । সেগুলি ছিল এ রকম -
আপনার নাম কি ?
আই এ তে আপনি কি কি সাবজেক্ট নিয়েছেন?
কোন সাবজেক্টটি আপনার বেশি পছন্দ ?
পাত্রী কোনো রকমে এই তিনটি প্রশ্নের উত্তর দিয়েই উঠে চলে যায় অন্দরমহলে ।
প্রশ্নের উত্তর পেয়ে জীবনানন্দের কি ধারণা হয়েছিল তা আমরা জানতে পারি না । তবে এর পরেই জীবনানন্দ বিয়েতে মত দেন ।১৯৩০ সালের ২৬শে বৈশাখ , শুক্লা চতুর্দশী তিথিতে ঢাকা শহরে খুলনা জেলার সেনহাটি গ্রামের রোহিনীকুমার গুপ্তর কন্যা লাবন্য গুপ্তর সঙ্গে বিয়ে হয়ে যায় কবি জীবনানন্দের ।
দেখতে এসে পাত্রীকে করা প্রশ্ন গুলি মধ্যে কোনো রোমান্টিকতার রেশ ছিল না এটা আমাদের মনে হতেই পারে ।
কিন্তু ফুলশয্যার রাতে ? আমাদের প্রিয় কবি কি কথা বলেছিলেন নবোঢ়া বধুকে ?
সে রাত্রে সংলাপ ছিল এই রকম
- আমি শুনেছি তুমি ভালো গান গাইতে পারো । আমায় একটা গান শোনাবে ?
- কোন গান ?
- জীবন মরণের সীমানা ছাড়ায়ে গানটা যদি জানো তবে সেটাই শোনাও
সে রাত্রে পর পর দু বার গান টি গাইতে হয়েছিল লাবণ্য কে । অনেক দিন পরে কবিপত্নী কবি জিজ্ঞেস করেছিল ফুলশয্যার রাতে এই গানটি কেন শুনতে চেয়েছিলেন ।
উত্তরে কবি বলেন – এই লাইন দুটির মানে জানো ?
আজি এ কোন গান নিখিল প্লাবিয়া
তোমার বীণা হতে এসেছে নামিয়া –
জীবনের শুভ আরম্ভ তে তো এই গানই গাওয়া উচিত , শোনা উচিত ।
এ পর্যন্ত যা জানলাম তা জানতে পারলাম তার অনেকটাই কবি পত্নীর লেখা ‘মানুষ জীবনানন্দ’ থেকে । এ বই তে যা লিখেছেন , বোঝা যায় তিনি খুব সন্তর্পণে লিখেছেন । ইচ্ছে করেই লিখতে চান নি এমন কিছু যাতে মানুষ জীবনানন্দের বিচিত্র স্বভাবের থেকে সৃষ্টি হওয়া দাম্পত্য সম্পর্কের ফাঁক গুলো ধরা পড়ে ।
এ বইতে মানুষ জীবনানন্দ আর সম্মন্ধে যা যা জানতে পারি তা সার সংক্ষেপ করলে দাঁড়ায় –
খুব সাধারণ জীবন যাপনে অভ্যস্ত ছিলেন ।মিলের ধুতি পরতেন ।তাও একটু উঁচু করে পরতেন মানে ধুতি হাঁটুর নীচে বেশি দূর নামত না ।এবং তাঁর জামা কাপড়ের ব্যাপারে কারো মন্তব্য গ্রাহ্য করতেন না। ডিম খেতে খুব ভালো বাসতেন । লেখার খাতা প্রাণপণে আগলে রাখতেন ।
দুই সন্তান মঞ্জুশ্রী আর সমরানন্দ কে খুব ভালোবাসতেন , যে কোনো গৃহী মানুষের মত ।ছোট বেলায় মেয়ের একবার অসুখ করে তখন মেয়েকে কোলে নিয়ে সারারাত পায়চারী করতেন । মেয়েকে রান্না ঘরে যেতে বারন করতেন , পাছে আগুনে পুড়ে যায় । আশা ছিল মেয়ে তার মত কবিতা লিখবে একদিন। ছেলের সঙ্গে বন্ধুর মত নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করতেন । একটু নার্ভাস প্রকৃতির ছিলেন ।
বিয়ের পর লাবণ্য বি এ পরিক্ষা দিয়েছিলেন কবিরই উৎসাহে । রেজাল্ট বেরোবার সময় তিনি এতটাই নার্ভাস ছিলেন রেজাল্টের খাম হাতে পেয়েও অনেকক্ষন ধরে নিজে কিছুতেই খুলতে পারেন নি খাম । কারো কাছে কিছু নিতে কুণ্ঠিত বোধ করতেন । বিয়েতে শ্বশুর বাড়ি থেকে একটি আংটি পেয়ে বেশ বিড়ম্বিত বোধ করেছিলেন ।
তবে তাঁকে দেখে যতটা শান্ত নিরীহ মনে হত আসলে তিনি তেমন ছিলেন না । লাবণয়র কথায় ‘ছাই চাপা আগুন’ । শান্ত ভাবে অল্প কথায় নিজের ব্যাক্তিত্য প্রকাশ করতেন কখনো কখনো ।
লাবণ্য দাশের স্মৃতিচারন পড়লে মনে হতে পারে তাদের দাম্পত্য জীবন মসৃন ভাবেই কেটেছে । কিন্তু তেমনটা বোধহয় নয় । ভুমেন্দ্র গুহ এবং অশোক মিত্র মশাই যাঁরা দুজনেই কবির খুব কাছের মানুষ ছিলেন তাঁদের স্মৃতিচারণে আমরা একটা অন্য রকম ছবি পাই । ‘মাল্যবান’ উপন্যাসে , যেটি কবির ভাই অশোকানন্দ দাশের মতে কবির ছদ্ম বেশে আত্নজৈবনিক উপন্যাস , সেখানেও দাম্পত্য সম্পর্কের অশান্তির দিকটি উঠে এসেছে । সে কথায় পরে আসছি ।
দিল্লির রামযশ কলেজে অধ্যাপনা করেছেন বিয়ের পরে বছর খানেক; ১৯৩৫ সালে বরিশালে চলে এসে যোগ দেন ব্রজমোহন কলেজে, ছিলেন ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত। ১৯৫১ থেকে '৫২ সাল পর্যন্ত পড়িয়েছেন খড়গপুর কলেজে, ১৯৫৩ সালে বারিষা কলেজে, পরের বছর হাওড়া গার্লস কলেজে তিনি অধ্যাপনা করেন। খরগপুর কলেজে অধ্যাপনা করার সময় সপ্তাহান্তে কলকাতায় চলে আসতেন এবং প্রায়শই কলেজ কামাই করে আরো কয়েকদিন থেকে যেতেন । তাই এই চাকরীটি চলে যায় । পরে ডায়মন্ড হারবার কলেযে একটি চাকরির ব্যবস্থা করে দেন তাঁর শুভনুধ্যায়ীরা । সে চাকরীতে তিনি যোগদান করেন নি যাতায়াতের অসুবিধার অজুহাতে । ঘন ঘন চাকরি হারানোর ফলে জীবনের অনেকটা সময় প্রচণ্ড অর্থকষ্টেই কেটেছে । গ্রাসাছাদনের জন্যে ইন্সিওরেন্সের দালালি পর্যন্ত করতে হয়েছে । তবু তার মধ্যে কিন্তু লেখা চালিয়ে গেছেন পুরো দমে । ওই এক জায়গায় তিনি কখনো হাল ছাড়েন নি । বোধহয় আগামী পৃথিবীর কথা ভেবে । সেটাই আমাদের পরম সৌভাগ্য ।
(শেষ হয় নি )
তাঁর অসামান্য সৃষ্টির কথা তো সকলেই জানি কিন্তু মানুষ হিসেবেও তাঁকে জানতে আগ্রহবোধ করি|

আরো পড়ুন
- 1