অরিন্দম কে - পর্ব 1
অরিন্দম ,
আমি লিখেছিলাম অনেক গানে সুরের কারুকার্য পরিস্কার ভাবে সব গায়ক বা গায়িকার কন্ঠে আসেনা । যেমন রবীন্দ্রনাথের টপ-খেয়াল অঙ্গের গান গুলি ,যেমন ধরুন “একি করুণা করুণাময়” ,”এ মোহ আবরণ খুলে দাও” , “অনন্ত সাগর মাঝে দাও তরী ভাসাইয়া” ইত্যাদি গান দেবব্রত বিশ্বাস এর কন্ঠে কখনও শুনিনি । এই সব গানে সুরের অলঙ্করণে যে সব তান ব্যবহার করা হয়েছে সেগুলির সার্থক রূপায়ণের জন্য কন্ঠের যে প্রস্তুতি লাগে ,আমার মনে হয়না দেবব্রত বিশ্বাসের তা ছিল । দেবব্রত বিশ্বাস নিজেই বলতেন গান জিনিষটা হল আমার পড়ে পাওয়া ধন । এই জাতীয় একটি বিখ্যাত গান – “কোথা যে উধাও হল মন প্রাণ” দেবব্রতবিশ্বাসের কন্ঠে শুনেছি বটে – কিন্তু সে গান অন্তত আমার ভালো লাগেনি – খুব আড়ষ্ট লেগেছে । এই সব গান শোনার জন্য আমি সুবিনয় রায় ,রাজেশ্বরী দত্ত বা মায়া সেন প্রমুখের কাছে অঞ্জলি পাতব । কারণ এই গায়ক গায়িকাদের কন্ঠে ওই সব গানে সুরের তান গুলি শুধু যে সাবলীল ভাবে আসে তাই নয় সুরের লাবণ্যটুকুও পুরোপুরি বজায় থাকে এঁদের কন্ঠে । প্রসঙ্গত উল্লেখ করব যে, শান্তিনিকেতনের ছাত্রী সাবিত্রী কৃষ্ণানের কন্ঠে “মীণাক্ষী মে মুদম” এই কর্ণাটী গানটি শুনে রবীন্দ্রনাথ এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে মূলগানের সুরটিকে অবিকৃত রেখে সেই সুরে বাংলা কথা বসিয়ে রচনা করেছিলেন বিখ্যাত গান “বাসন্তি হে ভূবন মোহিনী” । রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় বাসন্তি হে ভূবনমোহিনী গানটি গাইবার প্রয়োজন হলেই ডাক পড়ত সাবিত্রী দেবীর । একমাত্র তাঁর কন্ঠ ভিন্ন আর কারো কন্ঠে এ গান শুনতে রবীন্দ্রনাথ প্রস্তুত ছিলেননা ।
কিন্তু কেন এই তারতম্য ঘটে । হয়ত দীর্ঘ দিনের প্রণালীবদ্ধ শিক্ষা ও অনুশীলন দিয়ে এই দক্ষতা অর্জন করা সম্ভব । “হয়ত” শব্দটি সচেতন ভাবেই লিখলাম ,কারণ কন্ঠস্বরের গুনাবগুন আবার অনেকটাই নির্ভর করে ব্যক্তি বিশেষের স্বরোৎপাদনের অঙ্গ গুলি ,যথা ল্যারিংস এবং ভোকাল কর্ডের ধর্মের ওপরে । খেয়াল করে থাকবেন কাঁসর ও ঘন্টা দুটি একই ধাতুতে নির্মিত এবং একই কায়দায় বাজান হলেও তাদের ধ্বনিমাধুর্যে আকাশপাতাল পার্থক্য হয় । এ বিষয়ে গভীরতর অন্তর্দৃষ্টি লাভ করতে হলে আমাদের ধ্বণিতত্বের(acoustic science) এর শরণাপন্ন হতে হবে । আপাততঃ সে জটিল আলোচনায় প্রবেশ করছিনা ।
আপনি আরো যে দু জন বিখ্যাত শিল্পীর নাম উল্লেখ করেছেন তাঁরা দুজনেই ভিন্ন ভিন্ন কারণে আমার অত্যন্ত প্রিয় শিল্পী – অর্থাৎ হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এবং মান্না দে । দুজনের মধ্যে ব্যক্তিগতভাবে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় আমার কাছে অধিকতর প্রিয় ,যদিও বিশুদ্ধ সাঙ্গীতিক বিচারে মান্নাদে কে সম্ভবত কিছুটা হলেও এগিয়ে রাখতেই হবে । অন্ততঃ মান্নাদের গাওয়া গানগুলির সুর এবং আঙ্গিকগত বৈচিত্রের বিচারে তো বটেই ।
বাঙ্গালী শ্রোতাদের এক বিশাল অংশকে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় তাঁর রোমান্টিক কন্ঠের যাদুতে মজিয়েছিলেন । তাঁর গাওয়া শ্রেষ্ঠ গানগুলিতে কি সুরের খুব জটিল মারপ্যাঁচ ছিল কি ? আমার তো মনে পড়েনা । তবু কি এক আশ্চর্য দৈবী ক্ষমতা তাঁর কন্ঠে ছিল যা দিয়ে তিনি শ্রোতার মনে স্বপ্ন বুনতে পারতেন ।
অন্যদিকে মান্নাদের ছিল উচ্চাঙ্গের সাঙ্গিতিক তালিম ও উত্তরাধিকার । সপ্তস্বরকে নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী চালনা করতে পারতেন অবলীলায় । কিন্তু আমার বরাবরই মনে হয়েছে মান্নাদের গাওয়া অনেক গান ,যেমন “ও আমার মন যমুনার অঙ্গে অঙ্গে ভাব তরঙ্গে কতই খেলা” , “তীর ভাঙ্গা ঢেউ আর নীড় ভাঙ্গা ঝড়” “কত দূরে আর নিয়ে যাবে বল” ইত্যাদি বেশ কিছু রোমান্টিক গান হয়ত হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও সমান সাফল্যের সঙ্গে গাইতে পারতেন কিন্তু হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কন্ঠের “ও আকাশ প্রদীপ জ্বেলোনা” “আমার গানের স্বরলিপি লেখা রবে”র মত আরো বহু গান মান্নাদের কন্ঠে কি একই মায়াজাল সৃষতি করতে পারত শ্রোতার হৃদয়ে ? কিম্বা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া “শান্ত নদীটি পটে আঁকা ছবিটি” –সহজ সরল সুরের এই গান মান্নাদের কন্ঠে কি সমান নিপুনতার সঙ্গে অপূর্ব এক নিসর্গ চিত্রের জন্ম দিতে পারত ? কিম্বা হয়ত পারত ,হয়ত ভিন্নতর কোন চিত্রলোকে উত্তীর্ণ হত গানটি । এমন তো হতে দেখেছি । যেমন শ্যমল মিত্রর গাওয়া “যদি কিছু আমারে শুধাও” গানটির দেবব্রত বিশ্বাসের কন্ঠে এক নবতর রূপান্তরণে । সুরের পরিবর্তন না করেও নিজস্ব গায়নশৈলীর প্রয়োগ ঘটিয়ে একটি গানকে কোন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া যায় সে ত দেখেছি । এমন কি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া একটি বিখ্যাত গান “রানার” এই ত সেদিন সুমন চট্টোপাধ্যায় তাঁর বর্তমান প্রায় ভাঙ্গা কন্ঠে গেয়ে শোনালেন – শুধু শোনালেনই না – একেবারে মাতিয়ে দিলেন ।
আমি গানের বোদ্ধা নই আমার গান ভাল লাগে| আপনার লেখার সংগে সহমত্| কিন্তু একটা কথা আমরা কি মনের দিক দিয়ে খানিকটা ব্যায়াস নই গায়কদের প্রতি? মনে কোনে একটা গান কোন এক গায়ক বা গায়ীকার গলায় বসে যায়্| যখন অন্য কারো গলায় সেই গান শুনি তখন তার সংগে আমার জানার সংগে তূলনা করি|
আপনি হেমন্তের যে সব গানের উধাহরণ দিয়েছেন সেই সব গান আমার মনে হয়না অন্য কারো গলায় মন কে ছোঁবে| এখানে ব্যায়াস কাজ করে|
ব্যক্তি গত ভাবে রবীন্দ্রনাথের টপ্পা অংগের বা ব্রম্ভ সংগীত বেশীর ভাগের গলায় যায়না| হয়ত এই কথা এই আলোচনার বাইরে|
অপনদা

আরো পড়ুন
- 1