• 1

লেহ লাদাখ

null says: null

লেহ-লাদাখ ভ্রমন ডায়েরি
এক

দিল্লী থেকে লেহ বিমানযোগে লাগে এক ঘন্টা কুড়ি মিনিট ।ভোর পাঁচটায় দিল্লী থেকে রওয়ানা হয়ে যখন লেহ র ঘন কালো পাহাড় ঘেরা কুশক বাকুলা রিনপোছে বিমানবন্দরে নামলাম তখন আকাশ ভরা আলো ।বিমান থেকে নেমে মাটিতে পা রাখা মাত্র Public Address system এ ঘোষনা কানে এল ।সমুদ্রতল থেকে সাড়ে এগারো হাজার ফিট উচ্চতায় অবস্থিত লেহ অঞ্চলে আবহাওয়ায় অক্সিজেনের পরিমান স্বাভাবিকের চেয়ে অনেকটাই কম হওয়ায় অনভ্যস্থ যাত্রীদের শ্বাস কষ্ট ছাড়াও অন্যান্য সম্ভাব্য শারীরিক অসুস্থতার লক্ষণ দেখা দিতে পারে ।অতয়েব নিজেদের শরীরের প্রতি যাত্রীদের বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে ।
সতর্কবার্তার মর্ম হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া গেল অল্প ক্ষনের মধ্যেই – শুরু হল মাথার যন্ত্রণা । শুধু রক্ষে লেহ তে আমাদের প্রথম দিনে কোন কার্যক্রম ছিলনা ।বিমানবন্দর থেকে চমৎকার মসৃন পথে ধরে ভ্রমন সংস্থার গাড়িতে হোটেল লা সো তে ডেরা বাঁধার পর থেকে গোটা দিনটা বরাদ্দ ছিল আমাদের সম্পূর্ণ বিশ্রামের মধ্যে থেকে পাহাড়ি পরিবেশের সঙ্গে নিজেদের “এক্লেমাটাইজ” করে নেওয়া বা মানিয়ে নেওয়ার জন্য । নতুন জায়গায় আসার প্রাথমিক উচ্ছ্বাস কিছুটা থিতিয়ে এলে মনে হল এ কোন দেশে এসে পড়লাম রে ভাই।কোথায় মনের সুখে ডানা মেলে উড়ে বেড়াব তা নয় ,শরীর একটা বোঝা হয়ে ঘাড়ে চেপে বসে আছে ।

দুই
একদিন টানা বিশ্রামের পর একটু ধাতস্থ হবার পর শুরু হল আমাদের পথ চলা। উত্তরে দিগম্বর কারাকোরাম আর দক্ষিনে ঘন নীল হিমালয়ে ।এই দুই বিস্তৃত পর্বতমালার সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে পৌছে গেলাম তিব্বতী দ্রকপা সম্প্রদায়ের মনাস্ট্রী হেমিস গু্মফা ।একশ আশি ধাপ উঠে এই তিব্বতী মনেস্ট্রীর দালান ।ভিতরে আছে বুদ্ধের ধ্যানস্থ মূর্তি ,আছে একটি সংগ্রহশালা ।সংগ্রহশালায় বুদ্ধের জীবনের বিভিন্ন ঘটনাক্রমের বহু চিত্র ছাড়াও রয়েছে অনেক তৈজসপত্র , আর নানান আকারের ধাতব পাত্র । জানা গেল জুন মাসে নাকি এখানে পালিত হয় বর্ণাঢ্য উৎসব । হেমিস গুম্ফা থেকে বেরিয়ে আর চল্লিশ কিমি পথ পার হয়ে এসে পৌছলাম থিকসে নামে অপর একটি গুম্ফায়।সেখানে দেখা মিলল বিশাল এক বুদ্ধমূর্তির ।তার চোখে মুখে ছড়িয়ে আছে অনাবিল শান্তি আর স্মিত হাসি । সুউচ্চ পাহাড়চুড়ায় অবস্থিত গুম্ফাটি মনে শ্রদ্ধা জাগায়।
থিকসে গুম্ফাকে পিছনে ফেলে এগিয়ে চলি ।কিছুদুর যেতে না যেতেই দেখা হয়ে যায় সিন্ধু নদের সাথে ।রোমাঞ্চিত হয়ে উঠি ।এই সেই সিন্ধু নদ যার তীরে একদা গড়ে উঠেছিল সিন্ধু সভ্যতা । তিব্বতের মানস সরোবর এর কাছাকাছি এর উৎস । সেখান থেকে তার সুদীর্ঘ চলার পথে এসে মিলেছে অসংখ্য শাখা নদী বিভিন্ন জায়গায়।
দুর্গম পাহাড়ি পথে চলতে চলতে চোখে পড়ে কত বিভিন্ন আকৃতির পর্বতমালা কত রঙের বাহার তাদের ! কোথাও সে গেরুয়া কোথাও ঘন নীল । খুব আশ্চর্য লাগে সম্পূর্ণ গাছপালাবিহীন ন্যাড়া পাহাড় গুলোকে দেখে ।সামান্যতম সবুজের আভাস মাত্রও চোখে পড়েনা কোথাও । গাছগাছালি অনুপস্থিত কাজেই পাখির কুজন কাকলীও শোনা যায়না কোথাও ।মাথার ওপরে গাঢ নীল আকাশ আর পায়ের তলায় ,আমাদের চারপাশে ঘিরে থাকা পাহাড়ের পর পাহাড় !এ স্তব্ধ প্রকৃতি যেন এক মৃত্যু উপত্যকা । অবশ্য তারই মধ্যে জায়গায় জায়গায় চোখে পড়ে নীল আকাশের বুকে খন্ড খন্ড সাদা মেঘের দল অলস ভঙ্গীতে ভেসে চলেছে আবার কোথাও পাহাড়ের মাথা আলতো করে ছুঁয়ে । অবাক চোখে মেলে সেই সবদেখতে দেখতে একসময়ে পৌঁছে যাই চাংলা পাস । এই রাস্তা পৃথিবীর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মোটর চলাচলের রাস্তা ।
গাড়ি থামার পর মাটিতে নেমে অনুভব করি শ্বাস কষ্ট ।কিন্তু সেটুকু কষ্ট উপেক্ষা করেই ধীরে ধীরে হেঁটে চারপাশটা দেখেনিই । কিছু দৃশ্য হয় ক্যামেরাবন্দী
চাংলা পাস থেকে গাড়ি আমাদের নিয়ে এবারে ঢালু পথে ঘুরপাক খেতে খেতে চলল নিচের দিকে ।গন্তব্য প্যাংগং লেক ।

তিন
সমুদ্রতল থেকে ৪৩৫০মিটার উচ্চতায় অবস্থিত একশো পঁয়ত্রিশ কিমি দীর্ঘ প্যাংগং লেক এর চারভাগের তিনভাগই চীনের ভূখন্ডের অন্তর্গত ।শুনেছিলাম সুউচ্চ পাহাড়ের পায়ের তলে লুটিয়ে থাকা লেকের জল সূর্যালোকে থেকে থেকে রঙ বদলায় । কিন্তু আমাদের বিধি বাম ।লেকের জলে সেই নয়নাভিরাম রঙের খেলা দেখা আমাদের ভাগ্যে ছিলনা ।তাই হঠাত কোথা থেকে কাল মেঘ এসে আকাশকে ঢেকে ফেলল ।শুরু হয়ে গেল রিমঝিম বৃষ্টি । প্যাংগং লেকের জলে রঙের মেলা দেখা হলনা ।অতয়েব ব্যর্থ মনোরথ হয়ে ফিরে এলাম হোটেলে ।
পরের দিন নুব্রাভ্যালি যাবার পথে পড়ল খারদুংলা পাস ।নানা দিক দিয়ে এই গিরিবর্ত্ম টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । একসময়ে এই পথ দিয়ে মধ্য এশিয়ার সঙ্গে চলত বানিজ্য । ঘোড়া ও উটের পিঠে পন্যসামগ্রী বোঝাই করে এই পথ দিয়ে চলত ক্যারাভ্যান । তা ছাড়াও সামরিক দিক দিয়েও এই গিরিবর্ত্ম ভারতের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । সিয়াচীন হিমবাহে প্রহরারত ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর জন্য রসদ সরবরাহ হয়ে এই পথেই ।
খারদুংলা পাসের উচ্চতা নিয়ে কিছুটা ধন্দ আছে।শুনেছিলাম খারদুংলা পাস নাকি দুনিয়ার সর্বোচ্চ মোটর চলাচলের পথ ।সমুদ্রতল থেকে এর উচ্চতা ১৮৩৬০ফুট ।তবে সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী উচ্চতাটা আসলে সাড়ে সতেরহাজার ফূটের মত ।
খারদুংলায় পৌঁছনর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে শুরু হল তুষারপাত । চারিদিক আবছা হয়ে এল ।আমাদের ঘিরে থাকা পাহাড়গুলো পাতলা বরফের আলপনা আঁকা চাদর গায়ে দিয়ে সেজে উঠল ।আগের দিনের প্যাংগং লেকের হতাশা ঝেড়েফেলে নিজেদের বয়স ভুলে মেতে উঠলাম মাটি থেকে বরফের তাল কুড়িয়ে একে অপরের দিকে ছুঁড়ে মারার খেলায় ।খেলার ফাঁকে ফাঁকে দেখতে পাচ্ছিলাম কুয়াশার মত অস্পষ্টতা আমাদের ঘিরে ধরেছে । সেই আধোআঁধারিতে চারপাশের কারাকোরাম পর্বতমালা কেমন যেন রহস্যময় হয়ে উঠল ।ছেলেমানুষী খেলা ভুলে মোহাবিষ্টের মত তাকিয়ে থাকি সেই দিকে । তবে এবারে ভ্রমন সংস্থার গাইডের তাড়নায় ফিরে আসতে হল গাড়ির গর্ভে । আবার চলা ।
পথ চলতে চলতে একজায়গায় পৌছে দেখি সার দিয়ে সব গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়েছে । কি ব্যপার , না সামনের রাস্তায় পাহাড়ি ধ্বস নেমেছে । ভারতীয় সেনাবাহিনীর জওয়ানরা রাস্তা সাফ করে চলাচলের উপযোগী করে তোলার কাজ চালাচ্ছে । সুখের কথা মাত্র ঘন্টাখানেকের প্রচেষ্টায় রাস্তা খুলে গেল ।
গাড়ি সচল হবার পর অল্পক্ষণের মধ্যে পৌছলাম নুব্রাভ্যালিতে।চারিদিকে পাহাড় আর তার মাঝখান দিয়ে বয়ে চলেছে শায়ক নদী ।এই রাস্তা ধরে এগিয়ে গেলে পড়বে সিয়াচীন হিমবাহ ।ভারত-চীন Actual Line of control .সীমান্তের কাছাকাছি অঞ্চলে যাবার জন্য নুব্রাভ্যালি আসার পথে একটি চেক পোস্টে আমাদের বিশেষ পারমিট সংগ্রহ করতে হয়েছিল । যদিও সে কাজে বিশেষ জামেলা পোহাতে হয়নি। আমাদের ভ্রমন সংস্থার লোকজনই সব কাগজপত্র সাজিয়ে নিয়ে পারমিট সংগ্রহ করে এনেছিল । তবে আমরা সিয়াচীন হিমবাহের দিকে গেলামনা –গেলাম ন্যুরা ভ্যালির হোটেলে ।
নুব্রাভ্যালির হোটেলে পৌছে দেখা মিলল সবুজ গাছপালা আর পাখি ।হোটেলের বাগানে গাছে গাছে আপেল এপ্রিকট খুবানী আর আঙুর ফলেছে ।অবাক হলাম এখানে চড়ুই পাখি দেখে ।
লাঞ্চ সেরে নিয়ে আমরা চললাম হুন্ডার কোল্ড ডেজার্ট দেখতে । সেখানে দেখা পেলাম দুই কুঁজ ওয়ালা রোমশ এক নতুন ধরণের উটের । ভ্রমনার্থীরা প্রায় সকলেই সেই উটের পিঠে চড়ে কোল্ড ডেজার্ট ঘুরে দেখছেন দেখে আমারও সখ হল উটের পিঠে চড়ার । কিন্তু কি কুক্ষণেই যে আমার অমন দুর্মতি হয়েছিল তা ঈশ্বরই জানেন । প্রথমতঃ শত কসরত সত্বেও আমি কিছুতেই চড়তে পারিনা উটের পিঠে –ডান প্যাঁ তুলে উটের পিঠে চড়ার চেষ্টা চালাই কিন্তু হা হতোস্মি। পারিনা কিছুতেই ।সে এক বিদ্ঘুটে অবস্থা ।আমার সহিস তো হালই ছেড়ে দিল। আমি নাছোড়বান্দা। শেষেএকলাফ দিয়ে উটের পিঠে সওয়ার হওয়া গেল ।উট আমাকে পিঠে নিয়ে বসা অবস্থা থেকে উঠে দাঁড়ানর সময়ে এমন বিকট আওয়াজ করল যে তাতেই আমার আত্মারাম খাঁচা ছাড়া হবার উপক্রম হল । তাও নাহয় মেনে নেওয়া গেল ,কিন্তু উটের চাল ভারি অদ্ভুত রকমের ।উটের একএকটি পদক্ষেপের সঙ্গে সঙ্গে আমার শরীর এমন ভাবে তরঙ্গ দোলায় দুলতে আরম্ভ করল যে ভয়ে মরি কখন বুঝি উটের পিঠ থেকে আছাড় খেয়ে একেবারে “পপাত চ মমার চ” অবস্থা হয় আমার । এদিকে উটের সহিস ক্রমাগত চেঁচিয়ে আমাকে উপদেশ দিচ্ছে সোজা হয়ে না বসে শরীরটাকে একটু পেছন দিকে হেলিয়ে বসতে ।কিন্তু আমার কি আর তখন সে সব শোনার মত অবস্থা আছে? ফলে উটের পিঠ থেকে পড়লামনা বটে কিন্তু উটের সওয়ারির শেষে উটবাবাজি আমাকে পিঠ থেকে নামানর জন্য যেই না তার সামনের পাদুটো মুড়ে বসতে যাবে অমনি আমি টাল সামলাতে না পেরে একেবারে হুমড়ি খেয়ে পড়লাম উটের পিঠের ওপরে। উটের কুঁজে বিশ্রিভাবে আমার মুখটা গেল ঠুকে ।উটএর সহিস তখন তারস্বরে চেঁচিয়ে আমাকে বকেই চলেছে । আমি ততক্ষণে এক লাফে মাটিতে।
চার
ন্যুব্রা ভ্যালির হোটেলে এক রাত কাটিয়ে পরের দিন ফিরে এলাম লেহ ‘র হোটেলে এ ।সেখান থেকে অন্য একটি রাস্তা ধরে এবারে যাব কারগিল এ। একেবারে পাকিস্তান-ভারতের মধ্যবর্তী Line of control অবধি ।সকালে ঘুম থেকে উঠেই কারগিল এর কথা টা মনে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে অদ্ভুত উত্তেজনা অনুভব করি ।আমার ধারণা কারগিল যুদ্ধের স্মৃতি প্রত্যেক ভারতীয় নাগরিকের মনে একই রকমের উত্তেজনার জন্ম দেবে ।বিশেষ করে যে জায়গায় ভারতীয় ফৌজ মরণপণ সংগ্রাম করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পর্যুদস্ত করেছিল সেই যুদ্ধক্ষেত্রে আমি সশরীরে হাজির হব সেই ভাবনার রোমাঞ্চ লিখে বোঝাই এমন সামর্থ আমার নেই ।
সকালবেলা ছটা নাগাদ চা ব্রেকফাস্ট ইত্যাদি সঙ্গে নিয়ে আমরা গাড়িতে উঠে বসি । এখান থেকে কারগিল প্রায় দুশো কুড়ি কিলমিটার ।আগেরদিন প্যাংগং লেক এর রাস্তাছিল খুবই খারাপ ।গাড়িতে যেতে যেতে ঝাঁকুনিতে কোমর আর পিঠে ব্যথা হয়ে গিয়েছিল তার উপরে উটে চড়ার অভিজ্ঞতাটা ও শরীরের পক্ষে মোটেই সুখকর হয়নি ।তাই দীর্ঘ পথ গাড়িতে যাবার কথা চিন্তা করে কিছুটা ভাবনা হচ্ছিল বটে,কিন্তু দেখলাম কারগিলে যাবার সড়কটি ভারি চমৎকার ।মসৃণ রাস্তা দিয়ে আমাদের গাড়ি ছুটে চলেছে আর আমাদের সঙ্গে সঙ্গে চলেছে সিন্ধু নদ ।হাজার হাজার বছর ধরে সিন্ধু নদ এই ভাবেই নিঃশব্দে বয়ে চলেছে ।পথের দুপাশে সৌন্দর্য অপরূপ । এক নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে চলতে চলতে পৌছলাম দ্রাস নামে একটি নদীর ধারে গড়ে ওঠা একটি ছোট্ট পাহাড়ি শহর দ্রাসে । উচ্চতা জনিত কারণে শ্বাস কষ্ট ত ছিলই ,সেই সঙ্গে এবার যোগ হল প্রচন্ড ঠান্ডার কামড় । তবে এখানে আপাতত আমরা থামলামনা ।যদিও গাইড জানালেন কারগিল থেকে ফেরার সময়ে এই দ্রাসে একটি অদ্ভুত জিনিষ দেখতে পাব ।কিন্তু অদ্ভুত জিনিষ যে ঠিক কি তা কিন্তু তখনই ভাঙতে চাইলেননা ।
এই পথেই পড়ল লামায়ুরু নামে একটি গ্রাম – মুনল্যান্ড অফ লাদাখ বলে যার খ্যাতি ।এ গ্রামকে ঘিরে থাকা চারপাশের পাহাড়্ গুলি যেন পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় আলোকিত । বেশ কয়েকটি মনাস্ট্রী আর গোম্ফা আছে এখানে।তবে আমরা সেগুলিতে যাবনা ।
পাঁচ
কারগিলে পৌঁছতে বেলা বেড়ে লাঞ্চের সময় হয়ে গিয়েছিল ।তাড়াতাড়ি লাঞ্চ সেরে নিয়ে আমরা ছুটলাম কারগিলের যুদ্ধক্ষেত্রে । কারগিল এর যুদ্ধে যে সব বীর ভারতীয় জওয়ান নিজেদের প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিলেন তাদের স্মৃতিতে কারগিল পাহাড়ের পাদদেশে নির্মিত হয়েছে কারগিল শ্রদ্ধাঞ্জলি বেদি । বেদির মাঝখানে একশো ফুট উঁচু দন্ডের শীর্ষে উড়ছে ভারতের জাতীয় পতাকা ।অহর্নিশি জ্বলছে অমর জ্যোতি ।শ্রদ্ধাঞ্জলি বেদির একপাশে ফুলের বাগানে কারগিল যুদ্ধে যে সব সৈনিক শহীদ হয়েছেন তাদের নাম খোদাই করা অসংখ্য প্রস্তর ফলক রয়েছে ।বাগানের দুই পাশে রাখা আছে কারগিল যদ্ধে ব্যবহৃত বোফর্স কামান ,সাথে আছে একটি ছোট ফাইটার প্লেন । কাছেই একটি সংগ্রহশালায় কারগিল যুদ্ধে ব্যবহৃত নানান জিনিষ ।
এবার পালা আমাদের কারগিলে ভারত ও পাকিস্তান দুই দেশের মধ্যে line of control যেখানে ,সেই জায়গায় যাবার। যে গাড়ি চেপে আমরা কারগিল এসেছিলাম সে গাড়ি সামনের সঙ্কীর্ণ পথে যেতে পারবেনা। তাই গাড়ি বদল হল। এবার আমরা ছোট গাড়িতে ।সে গাড়ি যতই পাহাড়ের ওপর দিকে উঠতে থাকে ততই দেখি সংকীর্ণ পথের দুই পাশে খাদ গভীরতর হতে থাকে। প্রায় ঘন্টা তিনেক পাকদন্ডী পথ অতিক্রম করে পাহাড় চুড়ায় পৌঁছে দেখতে পেলাম আমাদের অবস্থান থেকে অনেকটা নিচে প্রতিবেশি দেশ পাকিস্তানের গ্রাম – তার ঘরবাড়ি মসজিদ ...।কথায় কথায় জানতে পারলাম Line of control এর এপারে দাঁড়িয়ে আমরা যেমন পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী এলাকাটাকে দেখছি তেমনি ওপারের পাকিস্তানী সেনাও সতর্ক নজরদারিতে রেখেছে আমাদের ।এ ভারি রোমাঞ্চকর ও শিহরণ জাগানো অভিজ্ঞতা । কারগিল যুদ্ধের ক্ষত শুকিয়ে গেছে কিন্তু ক্ষতচিহ্ন সম্পূর্ণ মুছে যায়নি ।জানাগেল এখনও পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর পোঁতা বহু মাইন ইতস্তত ছড়িয়ে আছে ।সামান্য অসাবধানতায় মুহূর্তের মধ্যে ডেকে আনতে পারে ভয়ঙ্কর বিপদ ।
১৯৯৯সালের হানাদারির পুনরাবৃত্তি রুখতে তাই এখন এত বছর পরেও ওই রকম দুর্গম জায়গায় অকরুণ প্রকৃতিকে উপেক্ষা করে ভারতীয় সেনাবাহিনী সদাজাগ্রত প্রহরায় মোতায়েন রয়েছে ।Line of control এর এ পারে ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর তৈরি করা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাপনা ঘুরে দেখা হল ।ওই এলাকায় ছবি তোলা নিষিদ্ধ তা না জেনেই কিছু ছবিও তুলেছিলাম –যদিও সে ছবি প্রকাশ্যে দেখান অনুচিত কাজ হবে বলেই সেগুলি আড়ালেই থাক ।
কারগিল থেকে লেহ’তে ফেরার পথে পাহড়ের গায়ে মেঘ আর রোদ্দুরের লুকোচুরি খেলা দেখতে দেখতে বেশ কিছু দূর চলার পর গাড়ি এসে থামল এমন একটি জায়গায় যেখান থেকে অনেকটা নীচে পাহাড়তলিতে জান্সকার আর সিন্ধু নদের সঙ্গম স্থল টি ভালোভাবে দেখা যায় । আমরা বিমুগ্ধ হয়ে দেখলাম দুপাশের পাহাড়ের খাঁজে জান্সকার নদীর নীলচে জল গিয়ে মিশে গেছে সিন্ধু নদের ঘোলাটে জলধারার সঙ্গে । গোটা পরিবেশটা যেন কোন নিপুণ শিল্পীর তুলিতে আঁকা ।
কারগিলে যাবার কালে পথে দ্রাসে একটি চমকপ্রদ জিনিষ দেখতে পাব বলে জেনেছিলাম আমাদের গাইডের কাছে । এই বারে আমরা সেই জায়গায় পৌঁছলাম ।গাইড মজা করার মত করে বললেন কারগিলে যাবার সময় আপনাদের একটা চমকপ্রদ জিনিষ দেখাব বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম ।এবারে সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করার পালা । আমরা এবার দেখব ম্যাগনেটিক হিল এর ম্যাজিক ।কথাগুলি বলতে বলতে ড্রাইভারকে কিছু ইঙ্গিত করলেন। গাড়ির চালক অমনি ইঞ্জিন বন্ধ করে দিয়ে ,ব্রেকের ওপর থেকে সরিয়ে নিল তার পা । অবাক কান্ড !!সাধারণত এমন অবস্থায় ঢালু পথে গাড়ি নিচের দিকে গড়িয়ে যাবার কথা ।কিন্তু আমাদের সবাইকে আশ্চর্য চকিত করে দিয়ে গাড়ি পিছনের চড়াই পথে পিছু হটতে শুরু করল । পরে গাইড আমাদের বোঝালেন যে এই অঞ্চলে পাহাড়ের নিচে আছে চৌম্বকীয় ক্ষেত্র যার আকর্ষণে আমাদের ধাতব গাড়িটি নিচের দিকে গড়িয়ে না গিয়ে ঢালের বিপরিতে ওপরের দিকে আকর্ষিত হয়েছিল ।সত্যিই এটা এমনই একটা চমকপ্রদ ঘটনা যে স্বচক্ষে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন ।
ম্যাগনেট হিল এর ম্যাজিক দেখে লেহ তে হোটেলে ফিরে এলাম ।পরের দিন সকাল সাতটায় লেহ বিমানবন্দর থেকে উড়ে চললাম ফিরতি পথে – দিল্লীর দিকে ।আর কোনদিন এখানে ফিরে আসব এমন দুরাশা করিনা ।তাই কিছুটা বিষন্ন দৃষ্টিতে প্লেনের জানালা দিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে দেখি হিমালয় আর কারাকোরাম পর্বতমালা। মনে হল তারা যেন আকাশের দিকে হাততুলে আমাদের বলছে অলবিদা ...।

says:
মনোজ ভট্টাচার্য    ইরা‚

খুব সুন্দর লাগলো তোমার লেহ-লাদাখের বর্ননা - ডায়রী ! গত বছরেই আমাদের এক বান্ধবী ঘুরে এসেছে ! কিন্তু সে তো লেখেওনি অথবা তার মুখের কথাও শুনিনি বা ছবিও দেখিনি !
এখনও তোমাদের দম আছে - যত পারো ঘুরে নাও ! আর এভাবেই বর্ননা করো ! তোমার লেখার মধ্যে দিয়ে - আমরাও খানিকটা ঘুরে আসতে পারি !

আর কিছু লিখছি না এখন !

মনোজদা
says:
ইরা চৌধুরী মনোজদা,
লেহ-লাদাখ ভ্রমন ডায়েরি আপনার ভালো লেগেছে শুনে নিশ্চিন্ত হলাম। কখনও কখনও নিজের লেখা পড়ে মনে হয় আরো ভাল লেখা যেত। লেহ-লাদাখ বেড়াতে গিয়ে একটু অন্যরকম স্বাদ পেয়েছিলাম। অক্সিজেন কম হওয়ার দরুন মাথা আর পায়ের মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই মনে হত। মাথা কোথাউ যেতে চাইছে পা কোথাউ চলেছে।মাঝে মাঝেই কোকা নামক হোমিওপ্যাথি গুলি মুখে দিতে হচ্ছিল। ব্যালেন্স রাকার জন্য। রাতে শুতে শুতে মনে হত হার্ট যেন বেশি দাপাচ্ছে। অথচ দিনেরবেলা সে আছে বোঝাই যেতনা। কী জ্বালা 😁
says:
মুনিয়া খুব ভালো লাগল‚ ইরাদি|
বিশেষ করে উঠের পিঠে চড়ে ভ্রমণের বর্ণনা অনবদ্য! 😆
says:
মনোজ ভট্টাচার্য    ইরা‚
এটা খুব সত্যিকথা যে লেখাটা আরো ভালো করা যেত - মনে হয়ই ! - তবে এও বলি - হিমালয়ের বর্ননা আর কতো ভালো লেখা যায় ! - সোনার হাতে সোনার কাকঁন !

আমি যেটা বলতে চেয়েছি - তোমার বা তোমাদের যতক্ষন দম আছে বা মনের জোর আছে - দুর্গম যায়গাগুলো ঘুরে নাও ! এই সব দুর্গম স্থানে গেলেই - মানে গিয়ে উঠতে পারলেই মনের যত স্ফুর্তি হয় - তার চেয়ে মনের জোর দ্বিগুন হয় ! চিরদিন এই স্মৃতিগুলো কাজ করে !

আর যেহেতু আমার আর সামর্থ নেই - তাই তোমাদের দিকেই তাকিয়ে থাকি - পিপাসার্ত চোখে !

মনোজদা
undefined says: undefined

আরো পড়ুন