ফেরারি ফৌজ - পর্ব 2
আগের সেই টিনের চাল আর চাটাইয়ের বেড়া নেই, থাকার কথাও নয়। প্রায় আটচল্লিশ বছর , কম কথা নয়। পিচের রাস্তা আর তার পাশে কালো হলুদের বর্ডার। অধিকাংশ বাড়ি পাকা। বিজনদার বাড়ি শেষ কবে এসেছিলাম? ওর ছোড়দির বিয়েতে। আমরা প্রায় পনের জন, পনের অশ্বারোহী। তার মধ্যে দুজন মেয়ে। একজন বিবাহিত। আমার সেলের কম্যান্ডার ও তার বৌ।
আমার সেলের প্রশান্তর আলগা মুখ। একবার সেল মিটিংয়ে কম্যান্ডারকে বলে দিল-- নিজে তো পার্টনার পটিয়ে নিলে, আমাদের খালি বিপ্লবের স্বপ্ন দেখাচ্ছ? আমাদের কী হবে?
--- বিপ্লবে প্রেম করা মানা নাকি? আমরা কি আনন্দমঠের সন্ন্যাসীর দল!
-- তা কই? পার্টি কই?
-- রিক্রুট কর। আমার বউ তো আমার রিক্রুট।
--উঁহু, মেয়েদের রিক্রুট করা বহুত ঝামেলি। সুশান্তকে জিগাও।
সেদিন লাজুক মুখচোরা সুশান্ত মুখ খোলেনি। কিন্তু বিয়েবাড়িতে সবার পেড়াপেড়িতে একরকম নিমরাজি হল।
-- আমি কিছু বলব না। প্রশান্তই বলুক।ওই আমাকে ডুবিয়েছিল।
সে কী?
-- বলছি বলছি। সুশান্ত প্রেমে পড়ছিল, পাড়ারই মেয়ে। পাঁড় কংগ্রেসি বাড়ি। আমার কাছে এসে কিন্তু কিন্তু করে বলে ফেলল। ব্যস্, আমি ওকে গাইড করতে লাগলাম। বললাম-- প্রেমে পড়ে বিপ্লবকে ভোলা চলবে না। সলিউশন? কংগ্রেসি বাড়ির মেয়েকে রিক্রুট করে কমিউনিস্ট বানাতে হবে। মায়াকোভস্কি বলেছেন-- প্রিয়ার গোলাপি ঠোঁটে চুমু খাওয়ার সময়েও যেন রিপাব্লিকের লাল পতাকা পতপত করে উড়ছে দেখতে পাই। প্রশান্ত আমার কথা মত কাজ করতে লাগল। বিপ্লব বোঝাল, শ্রেণীসংগ্রাম বোঝাল, কৃষিবিপ্লবও বুঝিয়ে ফেলল। শেষে যখন ওকে দলে আসতে বলল তখন মেয়েটি বলল যে তোমরা ছেলেরা কত স্বাধীন,সন্ধ্যের পরে দেরি করে ফিরলেও বাড়িতে কিছু বলে না। আমরা মেয়েরা কী আর করতে পারি বল? সেদিন ওই মুখচোরা সুশান্তের জিভে দুষ্টু সরস্বতী ভর করেছিলেন। তারপর কানে আমার ফুসমন্তর! ও অনায়াসে বলল-- বেশি না, একটা কাজ তো করতে পারিস! কিছু না হোক আমার মত গোটা কয়েক বিপ্লবী তো পয়দা করতে পারিস। তারপর কী হইল জানে শ্যামলাল।
তখন খাসির মাংস পাতে পড়েছে।
৭)
আগের সেই টিনের চাল আর চাটাইয়ের বেড়া নেই, থাকার কথাও নয়। প্রায় আটচল্লিশ বছর , কম কথা নয়। পিচের রাস্তা আর তার পাশে কালো হলুদের বর্ডার। অধিকাংশ বাড়ি পাকা। বিজনদার বাড়ি শেষ কবে এসেছিলাম? ওর ছোড়দির বিয়েতে। আমরা প্রায় পনের জন, পনের অশ্বারোহী। তার মধ্যে দুজন মেয়ে। একজন বিবাহিত। আমার সেলের কম্যান্ডার ও তার বৌ।
আমার সেলের প্রশান্তর আলগা মুখ। একবার সেল মিটিংয়ে কম্যান্ডারকে বলে দিল-- নিজে তো পার্টনার পটিয়ে নিলে, আমাদের খালি বিপ্লবের স্বপ্ন দেখাচ্ছ? আমাদের কী হবে?
--- বিপ্লবে প্রেম করা মানা নাকি? আমরা কি আনন্দমঠের সন্ন্যাসীর দল!
-- তা কই? পার্টি কই?
-- রিক্রুট কর। আমার বউ তো আমার রিক্রুট।
--উঁহু, মেয়েদের রিক্রুট করা বহুত ঝামেলি। সুশান্তকে জিগাও।
সেদিন লাজুক মুখচোরা সুশান্ত মুখ খোলেনি। কিন্তু বিয়েবাড়িতে সবার পেড়াপেড়িতে একরকম নিমরাজি হল।
-- আমি কিছু বলব না। প্রশান্তই বলুক।ওই আমাকে ডুবিয়েছিল।
সে কী?
-- বলছি বলছি। সুশান্ত প্রেমে পড়ছিল, পাড়ারই মেয়ে। পাঁড় কংগ্রেসি বাড়ি। আমার কাছে এসে কিন্তু কিন্তু করে বলে ফেলল। ব্যস্, আমি ওকে গাইড করতে লাগলাম। বললাম-- প্রেমে পড়ে বিপ্লবকে ভোলা চলবে না। সলিউশন? কংগ্রেসি বাড়ির মেয়েকে রিক্রুট করে কমিউনিস্ট বানাতে হবে। মায়াকোভস্কি বলেছেন-- প্রিয়ার গোলাপি ঠোঁটে চুমু খাওয়ার সময়েও যেন রিপাব্লিকের লাল পতাকা পতপত করে উড়ছে দেখতে পাই। প্রশান্ত আমার কথা মত কাজ করতে লাগল। বিপ্লব বোঝাল, শ্রেণীসংগ্রাম বোঝাল, কৃষিবিপ্লবও বুঝিয়ে ফেলল। শেষে যখন ওকে দলে আসতে বলল তখন মেয়েটি বলল যে তোমরা ছেলেরা কত স্বাধীন,সন্ধ্যের পরে দেরি করে ফিরলেও বাড়িতে কিছু বলে না। আমরা মেয়েরা কী আর করতে পারি বল? সেদিন ওই মুখচোরা সুশান্তের জিভে দুষ্টু সরস্বতী ভর করেছিলেন। তারপর কানে আমার ফুসমন্তর! ও অনায়াসে বলল-- বেশি না, একটা কাজ তো করতে পারিস! কিছু না হোক আমার মত গোটা কয়েক বিপ্লবী তো পয়দা করতে পারিস। তারপর কী হইল জানে শ্যামলাল।
তখন খাসির মাংস পাতে পড়েছে।
বিজনদাকে চিনতে একটু কষ্ট হল। ছ'ফিট লম্বা একটু মঙ্গোলীয় ধাঁচের মুখে এক্ধরণের একরোখা ভাবটা এখন অনেক নরম, কারণ সামান্য মেদ জমেছে। একমাথা কোঁকড়ানো চুলের জায়গা দখল করেছে এক মরুভূমি। সেই ছিপছিপে ছিলেটানা ধনুক ভাব উধাও, সকাল-সন্ধে মুখবুজে টিউশন করতে করতে একটু নুয়ে পড়েছে পিঠ।
কিন্তু হাসিটা আগের মতই প্রাণখোলা। তবে ঝক্ঝকে দাঁতে আগের মত নিকোটিনের ছাপ নেই।
চারমিনার কি বাজার থেকে উধাও হয়ে গেছে? নিদেনপক্ষে পানামা? বিজনদা কি আজকাল নিয়মিত ডেন্টিস্টের কাছে যায়? আগে তো ডেন্টিস্টের কাছে গিয়ে দাঁত চক্চকে করা, বিউটি পার্লারে গিয়ে রূপটান-- এসব তো বুর্জোয়া অবক্ষয়ের লক্ষণ ধরা হত। খেটে খাওয়া মানুষদের লড়াইয়ের রাস্তা থেকে সরিয়ে নিয়ে ব্যক্তিগত সৌন্দর্যের নার্সিসিজমে বেঁধে ফেলার ডেকাডেন্ট কালচারাল কনস্পিরেসি!
সবাই কেমন বিশ্বাস করত যে যারা বিউটি পার্লারে কাজ করে বা সেখানে ক্লায়েন্ট হয়ে যায় তাদের চরিত্র সন্দেহজনক।
তবে বিজনদা ছিল ওদের মধ্যে সবচেয়ে পিউরিটান। কোন আঁশটে চুটকি বা কমেন্ট, অভিধান-বহির্ভূত শব্দের ব্যবহার একেবারে সহ্য করতে পারত না। রেগে গেলেও কারও মা-বাপ তুলত না।মেয়েদের মাল বা গুল্লি বলা মানে প্রচন্ড ধমক খাওয়া। আর মাগী শব্দ মুখ থেকে বেরোলে হাতাহাতি হবার সম্ভাবনা। আঠেরো বছর বয়সের রমেন একবার পথে একজন গর্ভবতী মহিলাকে দেখে বলে উঠেছিল-- দেখেছেন, ওর না নিচের তলায় ভাড়াটে এসেছে।
দুজন সঙ্গী হ্যা-হ্যা করে হেসে উঠতে গিয়ে দেখল বিজনদাওর কলার মুচড়ে ধরে ঝাঁকাচ্ছে-- শালা! তোর লজ্জা করে না? অপদার্থ! তুই ওদের থেকে আলাদা কিসে?
বিজনদা এগিয়ে এসে দুহাতে জড়িয়ে ধরেছে রমেনকে।
--- কী রে! আমাদের ভুলে গেছলি? আর আমরও তো--।
রমেন কোন কথা বলে না, শুধু হাসতে থাকে। শংকর এগিয়ে এসে বলে --- ওঃ, আবেগের দুধ উথলে উঠেছে। ওকে ছেড়ে দাও , অনেক কথা আছে। আগে তোমার ছাত্রছাত্রীদের ছুটি দাও।
গোটাদশেক ছেলেমেয়ে চটপট খাতাবই ঢাউস ব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে ফেলে। বিজনদা রোববারের দিন এটা পুষিয়ে দেবে বলে অশ্বাস দেয়।
শংকর বিজনদার থেকে একটা সিগ্রেট চেয়ে নিয়ে ধরিয়ে ফেলে।
আমি আপত্তি জানাই; ওর বারণ আছে। ধোঁয়া গিলে কার কি উবগার হবে শুনি?
--কার বারণ, বৌয়ের? সেটা ঘরের মধ্যে। ঘরের বাইরে একটু অবাধ্য না হলে চলে?
---হ্যাঁ, হ্যাঁ; ঘরের মধ্যে অসভ্য আর ঘরের বাইরে অবাধ্য।
আমি চমকে উঠি। এই রে, বিজনদা ঝাড় দিল বলে। কিন্তু বিজনদার ঝকঝকে দাঁতে অমলিন হাসি।
শংকরের দিকে তাকাই। ও চোখ টিপে একটা ভঙ্গী করে বলল--চাপ নিস না, বিজনদাও লাইনে এসে গেছে।
একটু অস্বস্তি নিয়ে জিজ্ঞেস করি-- তো তুমি ঘরের মধ্যেই অবাধ্য কেন? বৌদি সিগ্রেট খাওয়া প্যাসিভ স্মোকিং নিয়ে কিছু বলে না?
বিজনদা উত্তর না দিয়ে জোরে হেসে ওঠে।
আমি ভ্যাবাচাকা। পালা করে দুজনের মুখের দিকে তাকাই।
--- না রহেগা বাঁশ, ন বজেগী বাঁসুরী!
--বুঝলি না ভ্যাবাগঙ্গারাম! বিজনদা বিয়েই করে নি।
--ও!
--মানে করে নি বললে ঠিক হবে না, বলা উচিত দ্বিতীয়বার করে নি।
--আচ্ছা, প্রথমবারটা কবে?
--- সেই যে রে! বিজনদার প্রথম রিক্রুট?
---রীনাদি! উনি এখন কোথায়?
বিজনদা বাইরের দিকে তাকায়, আবার একটা সিগ্রেট ধরায়। ঘরের ঘুলঘুলিতে দুটো চড়াই পাখি ঘর বাঁধছে। কিচিরমিচির। গোটা কয়েক খড়কুটো এসে আমার গায়ে মাথায় পড়ে। বিজনদা পরম মমতায় সেগুলো হাত দিয়ে সরিয়ে দেয়। ওর হাত আমাকে ছোঁয়, খানিকক্ষণ ছুঁয়ে থাকে। ভাবি, কোলকাতায় এখনও চড়ুইদের দেখা পাওয়া যায়!
আমি জল চাইলাম , বিজনদা উঠে ভেতরে গেল।
-- এই শালা! চটপট বলে ফ্যাল দিকি কি কেলো?
--- বিজনদা তখন বাঁকুড়া থেকে পুরুলিয়ার জেলে এসেছে। পার্টির শেলটার-ফেলটার ভেঙে ছত্রখান। যে যেদিকে পারছে পালাচ্ছে। আগের সমর্থকরা কেউ আর আমাদের মাথা গোঁজার জায়গা দিচ্ছে না। কাউকে বিশ্বাস করা যাচ্ছে না। বেলেঘাটায় পুলিশের ঢোকানো মোলগুলো মুখোস পরে অ্যাকশন স্কোয়াডের ছেলেদের ধরিয়ে দিল।
রীনাদি অন্য একটা উপদলে যোগ দিয়ে আমেরিকান লাইব্রেরিতে বোম ফাটিয়ে কাঁচ ভাঙল। একবার ধরা পড়ে বেইল জাম্প করল।
-- বেইল পেয়ে গেছল? কী করে?
--তখন পেটে ছ'মাসের বাচ্চা।তাই কোন বুড়ো সি জে এম--!
আমি ছটফট করি, উল্টোপাল্টা বকবক করতে থাকি।
-- আচ্ছা, পেটে বাচ্চা এল কেন? একটু সতর্ক হলে--।
--তুই কি বুঝবি রে আবাল! তুই তখন শান্ত ছত্তিশগড়ে বসে বাপের হোটেলে খাচ্ছিস দাচ্ছিস আর ইডিওলজিক্যাল কনফিউশন মারাচ্ছিস।
আমি হাসি। সে তো এখনও মারাচ্ছি। কিন্তু ওদের কি তখন "চার আনায় তিনটে" কেনারও পয়সা ছিল না?
-- এটা একেবারে বোকা-দার মত বললি। আরে তখন তো আমরা ফ্যামিলি প্ল্যানিংয়ে বিশ্বাস করতাম না। মাও নিজে লং মার্চের সময় ফ্যামিলি প্ল্যানিং করেন নি। আর ভাবতাম এসব গরীবদের মূল সমস্যার থেকে চোখ সরিয়ে দেওয়ার সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত। তর্ক করতাম--মানুষ শুধু পেট নিয়ে জন্মায় না, হাত-পা ও মাথা নিয়ে জন্মায়।
-- তখন যদি কোন শালা বলত যে খোদ মাওয়ের চীনে সত্তরের দশকে প্রধানমন্ত্রী চৌ এন-লাইয়ের নির্দেশে একাধিক বাচ্চা হলে প্রমোশন ইনক্রিমেন্ট আটকে দেওয়া হচ্ছে তো--।
--সে শালার গুষ্টির তুষ্টি করে ছাড়তাম। সে ঠিক আছে, তারপর কী হল?
-- রীনাদি এ বাড়ি সে বাড়ি ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে এমনকি নিজের মা-ভাইদের থেকেও রূঢ় ব্যবহার পেয়ে বদলে গেল।বিধবা সেজে উত্তরবঙ্গে একটা মাস্টারি যোগাড় করে চলে গেল। বিজনদার সঙ্গে কোন সম্পর্ক স্বীকার করে নি।
আমি কী বলব বুঝতে পারি না।
ঠিক এইসময় বিজনদা একটা থালার ওপর তিনকাপ চা দুটো লেড়ো বিস্কুট আর একগ্লাস জল নিয়ে ঢুকল। কী টাইমিং!
আচ্ছা, আড়াল থেকে আমাদের কথাবার্তা শুনছিল নাকি!
আমি চায়ে চুমুক দিতে দিতে পুরনো দিনে ফিরে যাই। বিজনদার সঙ্গে প্রথম পরিচয় কবে যেন?
হ্যাঁ, ১৯৬৭ সালের মে দিবস। বিজয়গড়ের থেকে মিছিল বেরোবে শুনে জুটে গেছি। তখন হায়ার সেকেন্ডারির ফল বেরোতে মাস দেড়েক বাকি। পুরোদমে টো টো করে ঘুরে বেড়ানো আর চারমিনার ফোঁকা চলছে। দুটো পায়জামা আর দুটো পাঞ্জাবী বানিয়েছি-- একটা গেরুয়া আর একটা কচি আমপাতা রঙের। পরে বেরোলে এখানে ওখানে আড্ডা দেওয়া উদ্বাস্তু কলোনীর দুরন্ত মেয়েরা আওয়াজ দেয়- দেখ দেখ, একজন নতুন কমরেড যাচ্ছে। কেউ কেউ পেছন থেকে কমরেড বলে চেঁচিয়ে ভালোমানুষ মুখ করে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকত।ভালো যে লাগত এ নিয়ে কোন কথা হবে না।
সেই মিছিল। বিজয়গড় এর একটি সাংস্কৃতিক চক্রের ছেলেরা মোড়ে মোড়ে ভ্যানরিকশায় চড়ানো মাইক নিয়ে সলিল চৌধুরির গান গাইছে -- আয় রে পরাণ ভাই, আয় রে রহিম ভাই।' গানটা প্রথম শুনলাম। তাতে কালো-নদীর-বান রোখার আহ্বানে বুকের মধ্যে কেমন করে উঠল। ছোটবেলায় পার্কসার্কাস পাড়ায় দেখা দাঙ্গার পরিবেশের ছবি ভেসে উঠল যেন।
সেখানে তানুদা পরিচয় করিয়ে দিল পায়জামা ও সবুজ পাঞ্জাবী পরা অসম্ভব ফরসা বিজয়দার সঙ্গে। তারপর ঘনিষ্ঠ হয়ে দেখেছি কিরকম ঘোর সংসারী বিজয়দা। তখন চাল দুষ্প্রাপ্য ও দুর্মূল্য। তখনও গলি গলিতে হাতরুটি বেলে বেলে মহিলারা বিক্কিরি করতেন না। আসলে বাঙালী তখনও রুটিকে শুধু জলখাবারের যোগ্য মনে করত।
চালের কর্ডন জেলায় জেলায়। র্যাশনের চাল মুখে তোলা কঠিন। বিজয়দা সাইকেল করে গড়িয়া-নরেন্দ্রপুর পেরিয়ে রাজপুরের বাজার থেকে প্রতিকিলোয় কুড়ি নয়া পয়সা কম দরে চাল কিনে আনত।
সেই বিজয়দা একদিন মা-বাবা-ভাই-দিদিকে ফেলে কিভাবে বিপ্লবের স্বপ্নে নিশির ডাকে সাড়া দিয়ে অনন্ত সিংয়ের ডাকাতির দলে ভিড়ে গেল সেটা এক রহস্য। নিজে গেল তো গেল, আমাদের কয়েকজনকে ও নিয়ে গেল যে!
-- অ্যাই বিজনদা, এ শালাকে একটু বোঝাও তো! চল্লিশবছর দন্ডকারণ্যে বনবাস করে ওর ঘিলু কেমন ভসকিয়ে গেছে, সোজা কথাও বুঝতে পারছে না।
বিজনদার মুখে প্রশ্রয়ের হাসি।
--কী, হয়েছেটা কী?
-- প্রথমতঃ আমি কোন বনবাসে ছিলাম না,ছত্তিশগড়ের স্টিল সিটি ভিলাই কি বন ? দ্বিতীয়তঃ--
-- চোপ্ শালা! দন্ডকারণ্য কি ছত্তিশগড়ে নয়? দ্বিতীয়তঃ আমাদের ইংরিজির মাস্টারমশায় দীনেনস্যার যে গণ-আদালত বসিয়ে চারটে ছেলেকে মৃত্যুদন্ড দিয়েছিলেন, সেই যে পদ্মপুকুর মাঠে গো, আর আমাদের অনেকের নামে খেলার মাঠের মারপিট নিয়ে মিথ্যে এফ আই আর করেছিলেন--সেটা ও কিছুতেই বিশ্বাস করছে না।
-- কেন?
--- ব্যাপারটা মেলে না, মানে ওঁর মাইন্ডসেটের সঙ্গে খাপ খায় না।
-- ওরে আমার সাইকোলজিস্ট রে! হুঁ, মাইন্ডসেট! সব ব্যাপারে বাতেলার অভ্যেসটা এখনো যায় নি।
--- সে তো তুই, বিজনদা সবাই।
--- কোথায় খাপ খুলছিস ? বিজনদা দশবছর আগে সাইকোলজিতে মাস্টার্স করেছে, ইগনু থেকে। আবার ডিজার্টেশনের বিষয় নিয়েছিল-প্যাসিভ অ্যাগ্রেসন সিনড্রোম। বুঝলি? তুমি বল বিজনদা।
--- হ্যাঁ, তোর খুব খারাপ লাগছে রমেন, কিন্তু কথাটা সত্যি। আমি তখন এদিকেই ছিলাম।
-- হল তো! আমরা সবাই ছিলাম, উনি ছিলেন না, তবু এঁড়ে তক্কো। আমার ঠাকুমা বলতেন-- রেখে দে তোর দেখা কথা, আমি শুনে এলাম।
---কিন্তু বিজনদা, এটা কী করে হয় ?ওঁর মত শান্ত ব্যক্তিত্বের একজন নিরীহ মানুষ--। উনি সিপিএম ক্ষমতায় আসায় কী খরগোস থেকে সিংহ হয়ে যাবেন?
-- আদ্দেকটা ধরেছিস। খরগোসের ক্ষমতায় আসা। ক্ষমতার সিপিএম-নকশাল-কংগ্রেস হয় না।সত্তরে যখন মানুবাবুরা যুব কংগ্রেসের পতাকার নীচে মাস্তানদের জড়ো করে কোলকাতাকে দুঃস্বপ্নের নগরী করে তুলেছিলেন তখন তোদের পাড়ার দত্ত বাড়ির ছ্যাবলা নিরীহ ছোটকা রাইফেল দিয়ে তোদের গাছ থেকে নারকোল টিপ করে পুকুরে ফেলে নি? পাড়ার চক্কোত্তি বামুনের ছেলে গামছায় শ্রাদ্ধবাড়ির চালকলা বাঁধা ছেড়ে বোমা বাঁধতে শুরু করেনি?
"সিরাজদ্দৌল্লা" নাটকে দানশা ফকির চরিত্রটা দেখেছিস? যে ছোটবেলা থেকে খোঁড়া, ব্যঙ্গবিদ্রূপ সয়ে বড় হয়েছে , সে কেমন সুযোগ পেয়ে মহা ভিলেন হয়ে উঠল। সেই যে রে , সেই বিখ্যাত ডায়লগ--যেমন তেমন দানশা পাইছ!
অবশ্য তোরা বোধহয় এসব পড়িস নি।
--পড়েছি, কিন্তু গুলিয়ে গেছে-- কে যে লিখেছিল? গিরিশ ঘোষ, নাকি শচীন সেনগুপ্ত?
--- ডি এল রায়ও হতে পারে, কি বল বিজনদা?
--আঃ, ফালতু কথা ছেড়ে বল, কী বুঝলি?
-- রমেন যে কিস্যু বোঝেনি, সে তো মুখ দেখলেই বোঝা যাচ্ছে। আমি বুঝলাম যে তোমার দুটো উপপাদ্য।
এক, ক্ষমতার সিপিএম -নকশাল হয় না। মানে যে যায় লংকায় , সেই হয় রাবণ।
দুই, ক্ষমতা পেয়ে খরগোসের সিংহ হওয়া। অর্থাৎ, ক্ষমতা নামক বায়বীয় শক্তি বেড়ালকে পোঁদে ফুঁ দিয়ে ফুলিয়ে বাঘ বানায়।
কিন্তু মাস্টারমশায়, আমরা ছাত্র হিসেবে ব্যাকবেঞ্চার। একটু কষ্ট কইরা উদাহরণ সহকারে বুঝাইয়া দেন।
মাস্টারমশায়ের গম্ভীর মুদ্রা । নীচুগলায় বললেন--এসব কথায় অনেক সময় লাগে। ভাতে ভাত হয়ে গিয়েছে, ডাল করাই আছে। যখন খেতে বসব তখন তিনটে হাঁসের ডিমের বড়া ভেজে দেব। আর আছে লংকার আচার। চলবে তো?
সেই আদি অকৃত্রিম বিজনদা, ঘোর সংসারী, পরিবারের সবার দিকে নজর, আমরা আড়ালে বলতাম-- বড়পিসিমা।
--শোন, এবার অন্য শিবিরের এইরকম অকারণ হিংস্রতার একটা গল্প বলি? মানে নকশালদের? সেখানেও একজন মাস্টারমশায়, তবে স্কুলের না, কলেজের।
-- কে বলত? আমরা চিনি?
--খুব চিনিস, কিন্তু নাম বলব না। এখন শান্ত ভদ্র বুদ্ধিজীবি, কাগজে প্রবন্ধ-টবন্ধ বেরোয়।অ্যাকাডেমিক লাইনে ব্রিলিয়ান্ট। তবে--।
বিজনদা আর একটা সিগ্রেট ধরিয়ে একমুখ ধোঁয়া ছাড়ে, তারপর ব্যোম মেরে যায়।
--আরে কী হল?
--দাঁড়া, ভাবছি কোত্থেকে শুরু করি। আচ্ছা রমেন, তুই তখন স্কটিশে ইকনমিক্স পড়তি না? রঘুবীর সেন তখন তোদের দু'ব্ছরের সিনিয়র ছিল, মনে আছে?
-- খুব মনে আছে। হেব্বি আঁতেল। "অনীক" পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিল। "এস আর " লাইন মারাতো। ওর বাপবুড়ো ভাল বেহালা বাজাত।
-- "এস আর" আবার কী?
-- তুই শালা গড়িয়া কলেজের মাল, তুই কোত্থেকে জানবি? আমরা হলাম প্রেসিডেন্সি কনসোলিডেশনের, বল্লে হবে? "এস আর" হল সোশ্যালিস্ট রেভোলুশ্যন গ্রুপ। যারা মনে করত ভারতে কৃষিতে পুঁজিবাদ এসে গেছে, সামন্ততন্ত্র পিছু হটছে। তাই এদেশে চীনের মত পিডিআর বা পিপলস ডেমোক্র্যটিক রেভোল্যুশন হবে না। তখন সিপিএম ও সরকারী নকশালদের একই মত ছিল, ভারতে বিপ্লবের স্তর হল পিডিআর বা কৃষি বিপ্লব। রঘুবীর পরে বড় ইকনমিক্সের অধ্যাপক হল, বিদেশে রিসার্চ করল। ইদানীং রিটায়র করেছে শুনছি। এবার তুমি বল, বিজনদা।
--- তখন রঘুবীর মাস্টার্স করতে সাউথ সিঁথির ইকনমিক্স বিল্ডিংয়ে গেছে। ওরা আটটা ছেলে চারটে মেয়ে; দুজন আজকের লব্জতে বেশ ঝিংকু। ওখানে তখন নকশালদের ইউনিট, মেয়েগুলিও তাই। রঘুবীরের একটু ইন্টুমিন্টু করার ইচ্ছে হল। ওর ব্যক্তিত্বের একটা আকর্ষণ তো ছিলই।
কিন্তু ও বাবা! কোথায় কি! যেন গোখরো সাপের বিলে এসেছে। মেয়েগুলো ওকে খালি রাগী রাগী চোখে দেখে, ভাল করে জবাব দেয় না। শেষে ওর কাছে খবর এল যে ওকে "এস আর" গ্রুপের তাত্ত্বিক প্রবক্তা হিসেবে শ্রেণীশত্রু ঘোষণা করা হয়েছে। ওর বেঁচে থাকার অধিকার নেই। খতমের তালিকায় নাম উঠে গেছে। মেয়েদের কাছে নির্দেশ পৌঁছে গেছে, তাই ওদের অমন সাপের মত হিস হিস্।
রঘুবীর বিশ্বাস করেনি যে ওকে মেরে ফেলা হবে। তবু সতর্ক হল। ভীড়ের বাসে বাড়ি ফিরতে লাগল। একা কোন গলিতে ঢুকত না।
কিন্তু ওপর থেকে যে অধ্যাপক নেতাটি ওর অজান্তে বিচারসভা বসিয়ে ওকে মেরে ফেলার পক্ষে রায় দিয়েছিলেন, তিনি অধৈর্য্য হয়ে উঠলেন। শেষে বেলেঘাটা ইউনিটকে দায়িত্ব দেওয়া হল। ওদের অ্যাকশন স্কোয়াড খুব দক্ষ।
একদিন রঘুবীর কিডন্যাপ হয়ে গেল। ওকে মুখ বেঁধে ট্যাক্সির ডিকিতে হাত-পা শেকল দিয়ে বাঁধা অবস্থায় রাত্তিরে শেয়ালদা -ক্যানিং রেললাইনে ফেলে দিয়ে গেল। পুরো হিন্দি ফিল্ম।
ঠিক সেভাবেই খবরটা পেয়ে ওর এক পুরনো বন্ধু একজনকে বোঝাল যে এস-আর হোক, যাই হোক --নকশাল তো বটেক। ওকে বাঁচাতে হবে। সেই পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল। তখনও কোন মালগাড়ি আসেনি। নইলে-। ওই অধ্যাপকটিও খুব ভদ্র, নরম স্বভাবের। কখনও কাউকে চড় মারেন নি।
এখনও এদিকে দু'একটা টালির ছাদওলা বাড়ি রয়ে গেছে। ফুটপাথ সিমেন্টের, তাতে একপাশে কালো হলুদ দিয়ে সোঁদরবনের বাঘের মত ডোরাকাটা। আঙিনার ভেতর থেকে কখনও উঁকিঝুকি মারে দোলনচাঁপা, জবা বা টগরফুলের গাছ। আর কোথাও ফুটপাথের গায়েই পুরনো মাস্তানের মত মাথা তুলে সগর্বে দাঁড়িয়ে আছে একটা নারকোল গাছ। বয়সের ভারে হেলে গেছে।
সন্ধ্যে নেমেছে অনেকক্ষণ।
কিছু জিন্স ও লেগিংস পরা কিশোরী চলে যায় কলকল করতে করতে, পিঠে ঢাউস ব্যাগ, গন্তব্য সম্ভবতঃ কোন কোচিং ক্লাস। পাড়ার ভিতরে ত্রিফলাবাতি নেই।কিন্তু ল্যাম্পপোস্ট অগুনতি। বেশিরভাগের মাথায় আলো জ্বলছে।
আমরা ফিরছি। অনেক অনেক আড্ডা হল। চলে আসার সময় বিজনদার বিষণ্ণ মুখ। আবার আসিস কিন্তু। তুই তো এখন কোলকাতাবাসী হয়ে গেছিস। অসুবিধে কী?
-- হ্যাঁ, হ্যাঁ। আসবে না মানে? ওর ঘাড় আসবে।তুমি এমন রেঁধে বেড়ে খাওয়াবে আর ও আসবে না।
--ধ্যাৎ, আমি কি খেতে পাই নে? নাকি হ্যাংলা?
--দুটোই। তোর মত যেচে একা থাকার লোকেরা নিজেরা কত রেঁধে খায় আমার জানা আছে। তোদের দর্শন হল-- ভোজনং যত্র তত্র, শয়নং হট্টমন্দিরে।
--- ভাগ শালা! তোর মত ফ্ল্যাটের মালিক নই, কিন্তু মাথার ওপর একটা ছাদ ঠিকই আছে। এজমালি তো কি?
বিজনদা হাসে। বাগানের কাঠের দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে বাইরে আসে। মনে হয় গলির মুখটা অবদি এগিয়ে দেবে।
--কিছু মনে করিস না রমেন, ও তোকে হিংসে করছে। মানে তোর স্বাধীনতা, সে ওর কপালে নেই।
--- ভুল বুঝছ বিজনদা! তোমরা দুজনই উমাহারা মহেশ্বর। শ্মশানে মশানে বাস। পুরনো দিনের গাঁজার ধোয়ার মৌতাতে তোমাদের জমবে ভাল।
--- কাল আসতে পারবি?
--না, না। কাল নয়। পরে আরেকদিন। ওর মিশন ফেরারি ফৌজ চলছে যে! খুঁজে বেড়াচ্ছে পুরনোদিনের সাত ঘোড়সওয়ারকে।
--- ক'জনকে পেল?
--- বিমলেন্দু, আমি আর তুমি। এখনও চারজন বাকি।
-- তো কালকে কার ইন্টারভিউ নিবি?
--- না, বিজনদা, ইন্টারভিউ-টিউ নয়। আমি দেখতে চাই তোমরা কেমন আছ? কী ভাবছ? প্রায় আদ্দেক শতাব্দী পেরিয়ে গেল যে! এই বদলে যাওয়া সময়টাকে বুঝতে চাইছি, ধরতে চাইছি।
-- বেশ তো, কাল কার বাড়ি যাবি বল?
--বুঝতে পারছি না। ভাবছি আমাদের চে গুয়েভারা সজলের খোঁজ নেব। সেই যে ছোটবেলা থেকেই হাঁপানীতে খুব ভুগত আর নিজেই দরকার মত ডেরিফাইলিন, অ্যামিনোফাইলিন ইঞ্জেকশন ঠুঁসে দিত। এর পরে প্রিয়ব্রতর বাড়ি। শংকর হটাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল। বিজনদা অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমাকে দেখছে।
এদিকে আজকাল গাছে গাছে ঝোপেঝাড়ে জোনাকিরা জ্বলে- নেভে করে না। কোথাও টিভিতে পুরনো ফিল্মি গান বাজছে-- রমাইয়া বস্তাবইয়া! রমাইয়া বস্তাবইয়া! তেলেভাজার দোকানের সামনে কিছু লোকজনের গজল্লা।
--কী হল? অমন চুপ মেরে গেলে যে?
-- কেন তুই জানতিস না?
--কী জানব?
--- ওরা দুজনেই নেই।
--কোলকাতার বাইরে? আমার মত প্রবাসী বাঙালী?
--- না, ওরা দুজনেই মারা গেছে। সেই সত্তরের প্রথম দিকে।
--- সে কী? কী করে? কী হয়েছিল?
-- ওসব শংকরের থেকে পরে শুনে নিস। তোরা এখন যা! ভালো লাগছে না।
৮)
দুদিন পরে শংকর এসে হাজির হল আমার অস্থায়ী ডেরায়।
আমার হাতের তৈরি কালো চা খেয়ে মুখ ভেটকে বলল -- সামান্য চা টাও ঠিক করে বানাতে পারিস না। তোকে নন্দিতাবৌদি আশকারা দিয়ে মাথায় তুলেছিল। পরে বুঝেছে যে এমন অপদার্থ লোককে মাথায় রাখলে বোঝা বাড়ে, তাই নামিয়ে দিয়েছে।
আমি মুচকি হাসি। কিন্তু কোথায় যেন খচ্ করে লাগে। হয়ত আমার মুখের ভাবে সেটা কিছু ফুটে উঠেছে। শংকর অপ্রস্তুত।
--সরি! অ্যাদ্দিন বাদে দেখা। এমন ইয়ার্কি করা ঠিক হয় নি। আগের দিন হলে তো--।
--ঠিক আছে। আমি কিছু মনে করিনি। ওর সঙ্গে সব চুকে বুকে গেছে, বললাম তো! কাটিয়ে দে।
ও চুপ মেরে যায়। এদিক ওদিক তাকায়। কোথায় যেন তাল কেটে গেছে। তারপর আমি বাধা দেবার আগেই ফস করে একটা সিগ্রেট ধরায়।
-- এটা কি ঠিক করলি? ডাক্তারের বারণ আছে না?
--ছাড় তো! ডাক্তার? তিনকুড়ি পেরিয়ে গেছি, তুই আমি সব্বাই। এখন যা হবার তা হবে। দীর্ঘজীবন লাভ? তাহাতে কাহার কয় গাছি কেশ উৎপাটিত হইবে?
--- তা বলে তুই ডাক্তারের কথা শুনবি না? বৌদির সামনে দাঁড়িয়ে বলতে পারবি? বা তোর দুই মেয়ের সামনে?
-- ডাক্তারের সুপরামর্শ? নচিকেতা যমকে বলিলেন--ইহা কি অমৃত? যম নিরুত্তর। তখন নচিকেতা ঘোষণা করিলেন- যেনাহংমৃতস্যাম্, তেনাহং কিমকুর্য্যাম্? যাহা অমৃত নয়, তাহা লইয়া আমি কী করিব?
--- টীকা করুন নীলকন্ঠবাবু! আমি মহামহোপাধ্যায়ের কথার পাঠোদ্ধার করিতে অপারগ।
--- অর্থাৎ যে পথে গেলে বিপ্লব হইবে না তাহা শুনিয়া আমি কী করিব? তেরে অঙ্গনে মেঁ মেরা ক্যা কাম হ্যায়?
--- তো কোন পথে গেলে বিপ্লব হইবে তাহা আপনি জানেন?
-- আমি? বকরূপী ধর্ম যুধিষ্ঠিরকে জিগাইলেন কঃ পন্থা? যুধিষ্ঠির বলিলেন-মহাজনো যেন গতঃ স পন্থা। কিন্তু আজকে এই একুশ শতকে আমার মনে হয়-- কোন মহাজন পারে বলিতে? কাউকে বিশ্বাস করি না। তোকেও না।
শালা সাতটা ঘোড়সওয়ার খুঁজে বেড়াচ্ছেন! যেন বিষ্ণু দে পড়ে ঘুম থেকে উঠেছেন।
--- যাক, তাহলে তোর এখনও বিপ্লব হওয়ায় বিশ্বাস আছে, বাঁচালি!
-- অ্যাই, অ্যাই বানচোত্! আমার মুখে কথা বসাবি না।
--- আমি বসাই নি। যদি বিশ্বাসই না থাকে তো খুঁজে বেড়াচ্ছিস কেন?
--- আচ্ছা, তোর কেসটা কী বলত? তোর কোথায় খুজলি হচ্ছে?
--- মানে?
--- মানে খামোকা পুরনো ঘায়ের ওপর থেকে পাপড়ি টেনে তুলছিস কেন? ধান্দাটা কী?
---- ফের ভাট বকছিস! তার চেয়ে সজল আর প্রিয়ব্রত কী করে মারা গেল সেটা বল। বিজনদা বলল না তোর থেকে শুনে নিতে?
---- শুনে কী হবে রে গুষ্ঠির পিন্ডি?আচ্ছা, তুই কী বাঙালী?
--- তবে না তো কি ছত্তিশগড়ি?
-- হতেও পারিস, শালা দো-আঁশলা কোথাকার।
-- এবার মার খাবি, তোর কি হল বলত?
-- হবে আর কি? কোন শালা বাঙালীর চারদিকে যা ঘটছে তা নিয়ে কোন হেলদোল আছে? সবার শালা একই ফান্ডা-- শাকভাত খাই, পকপক দেই!
আমি হেসে ফেলি।
--- তুই মাইরি একই রকম রয়ে গেলি! কোন পরিবত্তোন নেই।
গর্জে ওঠে বিজন-- না! পরিবত্তোন হয়েছে। সবার হয়েছে। তোর আমার সবার। এই বঙ্গে সবার নুনু গুটিয়ে দুপায়ের ফাঁকে সেঁদিয়ে গেছে। নইলে আজ এদিন দেখতে হয়!
--হ্যাঁ, বিজনদা বলেছে বটে। কিন্তু নিজে শালা মুখ ফুটে বলতে পারল না। ঘাটকাজের দায়টা আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে সটকে গেল। শালা বুড়ো ভাম!
শংকর বিড়বিড় করতে করতে দুহাতের বুড়ো আঙুলের নখ ঘষতে থাকে।
-- তোর কী হয়েছে বলত? বাবা রামদেবের চ্যালা হয়েছিস? এভাবে নখ ঘষলে টাকে দুগাছি চুল গজায় না কি যেন!
--শোন রমেন। আজ যে প্রিয়ব্রত বেঁচে নেই এর জন্যে দুজন প্রত্যক্ষ ভাবে দায়ী। আমি আর বিজনদা।
-- কী আটভাট বকছিস?
-- না রে! আমরা দুজন প্রত্যক্ষভাবে দায়ী।
--অংক কঠিন লাগছে।
ওর মুখ চোখের অবস্থা দেখে কুঁজো থেকে জল গড়িয়ে দিই। ঢকঢক করে খেয়ে একটু ধাতস্থ হয়ে ও মুখ খোলে।
মনে পড়ে রমেন? ১৯৬৮র শেষের দিকে এক শীতের সন্ধ্যায় তুই আমাকে অনন্ত সিংয়ের ওই এমএমজি বা ম্যান-মানি-গান নামক দলের সদস্য বানালি।
আর ছ'মাস পরে আমি রিক্রুট করলাম প্রিয়ব্রতকে।
--খুব মনে আছে। ওটা একটা ডাকাতের দল ছিল, মানে সেই অনুশীলন-যুগান্তর দলের স্বদেশী ডাকাতদের মত। আসলে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের রোমান্টিক খোঁয়াড়ি অনন্ত সিংয়ের বুড়ো বয়্সেও কাটেনি। কিন্তু দলটার ফর্ম্যাল নাম ছিল সি সি সি আর আই।সেন্ট্রাল কোঅর্ডিনেশন অফ কম্যুনিস্ট রেভোলুশনারিজ অফ ইন্ডিয়া না কি যেন! আর অনন্ত সিংয়ের নিক ছিল ওল্ড গার্ড, তাই না? একটু একটু মনে পড়ছে।
--ধুস্! অনন্ত সিং একটি মানসিক রোগী ছিল। বড় বড় কথার আড়ালে শুধু অস্ত্র জোগাড় কর আর তার ট্রেনিং নাও। কোন রাজনৈতিক লাইনের ধার দিয়ে যেত না। ওর চোস্ত ইংরেজিতে লেখা সার্কুলারগুলো মনে আছে? সেই যে রে ওল্ড গার্ড নাম দিয়ে সাইন করে পাঠাত? তাতে শুধু গোপন আড্ডা আর সিক্রেসির কথা, যেন বিপ্লবী নয়, স্পাইদের সংগঠন!
--ওসব থাক, প্রিয়ব্রতর কথা বল।
--বলছি, দাঁড়া না। তোকে, আমাকে আর, প্রিয়ব্রতকে আলাদা ইউনিটে দেওয়া হল। প্রিয়ব্রতর ইউনিটের লিডার বিজনদা। অনন্ত সিং জানতে পারল যে প্রিয়ব্রত বিধবা মায়ের একমাত্র ছেলে। মা ভালই পেনশন পেতেন আর ব্যাংকে ওর বাবার কিছু জমানো টাকা ছিল। বিজনদাকে দিয়ে ওকে বলানো হল যে ব্যাংক থেকে দশহাজার টাকা তুলে আনতে। অস্ত্র কিনতে লাগবে। ওর আর মায়ের জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট। মাকে ভুজুং-ভাজুং দিয়ে চ্কে সই করিয়ে টাকাটা তুলতে হবে, মা তো আর ব্যাংকে যাবে না।
উনিশ বছর বয়স। প্রিয়ব্রত ডিসিপ্লিন ভেঙে আমার সঙ্গে দেখা করে জানতে চাইল কাজটা উচিত হবে কি?
ততদিনে পার্ক স্ট্রীট পোস্ট অফিস ও রাসেল স্ট্রীটের স্টেট ব্যাংক ডাকাতি দুটো সফল। বুড়োর হাতে লাখদশেক টাকা এসেছে। তবে আবার এই টাকার খাঁই কেন?
আমি গিয়ে বিজনদার সঙ্গে দেখা করলাম। সিক্রেসি ভঙ্গ করায় বিজনদা খুব রেগে গিয়ে প্রিয়ব্রতকে খুব বকল। বলল অবিনাশের নির্দেশ সংগঠনে কেউ কোশ্চেন করে না। উনি অগ্নিযুগের পোড়খাওয়া বিপ্লবী। এ টাকাটা চাওয়া হচ্ছে প্রিয়ব্রতর বিপ্লবী কর্মকান্ডের প্রতি ডেডিকেশন কতটা বোঝার জন্যে। কোন চাপ নেই। প্রিয়ব্রত ফিরে যেতে পারে। প্রিয় আমার মত জানতে চাওয়ায় তখন বলেছিলাম যে সংগঠনের আদেশের বাইরে আমার আলাদা করে কিছু বলার নেই।
বিপ্লব থেকে বাদ পড়ে যাবে, দুধভাত হয়ে যাবে? উনিশ বছরের ছেলেটা নিজের সতীত্বের পরীক্ষা দিতে পরের দিন সন্ধেবেলা দশহাজার টাকা এনে বিজনদার হাতে তুলে দিল। অনন্ত সিং খুশি। সংগঠনে বিজনদার ধক বেড়ে গেল।
কিন্তু এর ঠিক তিন মাস পরে তুই আমি বিজনদা সব্বাই ওই ডাকাতের দল ছেড়ে এম-এল পার্টিতে যোগ দিলাম। সেখানেও প্রিয় বিজনদার সঙ্গে সেঁটে রইল।
ইতিমধ্যে চারু মজুমদারের "গেরিলা অ্যাকশন সম্পর্কে কয়েকটি কথা" দলিল বের হয়ে চারদিকে হৈচৈ ফেলে দিয়েছে।
বিজনদা আর প্রিয় ওই লেখাটা পড়ে বার খেয়ে চলে গেল সুন্দরবনের গোসাবা এলাকার একটি প্রত্যন্ত গ্রামে।
সেখানে একটা বাঘা জোতদারকে টার্গেট করল।
কৃষ্ণপক্ষের রাত। ওরা ছ'জন। বিজনদা, প্রিয় আর চারজন ভূমিহীন ক্ষেতমজুর। পরে জেনেছিলাম যে আসলে ওরা হল তাড়িখেকো লুম্পেন প্রলেতারিয়েত।
বিজনদা ও আর একটা ক্ষেতমজুর জোতদারের বাড়িতে দুদিন ধরে বাগানের ঘাস আর আগাছা সাফ করার অছিলায় ভাল করে রেকি করল।
তারপর রাত্তিরে দুটো গুপ্তি আর ছুরি ও কাটারি নিয়ে হামলা করে বুড়ো জোতদারকে মাটিতে শুইয়ে দিল। কিন্তু বিজনদার তদন্তে ভুল ছিল।
ওরা জানতে পারে নি যে জোতদারের ঘরে বন্দুক আছে। দোতলার বারান্দা থেকে বুড়োর মাঝবয়েসি ছেলে গাদা বন্দুক থেকে ফায়ার করতেই একজন তাড়িখোর লুটিয়ে পড়ল। বাকিরা পালাল। কিন্তু শহুরে ছেলে প্রিয়ব্রত পারল না। অন্ধকারে আলপথে দৌড়তে গিয়ে খেজুর কাঁটা বিঁধে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল। এদিকে ওদের বাড়ি থেকে 'ডাকাত পড়েছে ডাকাত পড়েছে' শোর উঠেছে। একটু একটু করে জ্বলে উঠছে কুপি আর লন্ঠন। জ্বলে উঠছে মশাল। ঘর ঘর থেকে লাঠি সোঁটা কুড়ুল নিয়ে লোক বেরিয়ে আসছে দলে দলে। প্রিয়ব্রতরা তিন জন ধরা পড়ে গেল। বিজনদা ও বাকি দুজন পালিয়ে গেল।
ওদের ধরে এনে জোতদারের আঙিনায় থামের সঙ্গে বেঁধে শুরু হল গণধোলাই, একেবারে হাটুরে মার।
এর মধ্যেই প্রিয়ব্রত চেঁচিয়ে বলতে লাগল-- ভাইসব, ভুল করছ। আমরা ডাকাত নই। আমরা তোমাদের বন্ধু। তাই জোতদারের শত্রু। এই পরিবারটি বছরের পর বছর তোমাদের ঠকিয়েছে। মিথ্যে কাগজ বানিয়ে জমি জিরেত দখল করেছে। তোমাদের ভিটেমাটি ছাড়া করেছে, তোমদের মা-বোনেদের দিকে কুনজর দিয়েছে। তাই ওকে শাস্তি দিতে এসেছিলাম।
মার কমতে কমতে বন্ধ হল। দুজন ওদের বাঁধন খুলে দিতে গেল। কিন্তু এর মধ্যে বুড়ো জোতদারটা মুখে রক্ত তুলতে তুলতে নিথর হয়ে গেল আর ওর ছেলেটা প্রিয়র গায়ে গাদা বন্দুকের নল ঠেকিয়ে ঘোড়া টিপল। ওর বডি যখন পুলিশের গাড়িতে করে ওদের বাড়িতে পৌঁচে গেল তখন সেখানে বিজনদা বা আমি কেউ ছিলাম না। পরেও মাসিমা আমকে বারবার খবর পাঠিয়েছেন। হিম্মত হয় নি ওঁর সামনে গিয়ে দাঁড়াতে, ওঁর চোখের দিকে তাকাতে।
ভাবতে ভাল লাগে যে এতদিনে উনিও বোধহয় ওর ছেলের কাছে চলে গিয়েছেন।
৯)
আমি আবার চা বানাই। শংকর পর পর চারটে সিগ্রেট খেয়ে প্যাকেট শেষ করে ফেলে। আমি চোখের ইশারায় বুঝিয়ে দিই যে এই শেষ, আজ আর নতুন প্যাকেট খোলা হবে না।
ওর গলার স্বর ভাঙা ভাঙা।
--- আজও নিজেকে ক্ষমা করতে পারিনি রে। বিজনদা নিজেকে দোষ দেয়, কিন্তু ও তো সব সময় আমার মত জানতে চাইতো।
আমি কখনই চারু মজুমদারের ওই দলিলের লাইনটা মানতে পারিনি। সমানে তর্ক করেছি।
তুই ভাব তো-- যে শ্রেণীশত্রুর রক্তে হাত রাঙায় নি, সে কম্যুনিস্ট নয় -- এটা কোন কথা হল? তাহলে তো মার্ক্স থেকে হো চি-মিন সবার হাত ধুয়ে ধুয়ে ল্যাব টেস্ট করে দেখতে হবে কার হাতে কতটা কিসের রক্ত লেগে আছে! এটা সায়েন্টিফিক লাইন? এ তো সেই কালীপূজো করা বাঙালীর কথা! বিপ্লবের নামে তন্ত্রসাধনা!
----চারু মজুমদারের পাগলামির প্রায়শ্চিত্ত ভদ্রলোক নিজের জীবন দিয়ে করে গেছেন। তার দায় তুই নিজের ঘাড়ে নিয়ে ফালতু অপরাধবোধে ভুগছিস কেন? বাকি লোকজন কী ছিঁড়ছিল? কানু-খোকন- কেশব --কদম? আর জংগল সাঁওতাল? পুলিশের কোডে ফোর কে অ্যান্ড ওয়ান জে! চীন ঘুরে আসা সৌরীন বসু? কাং শেং আর চৌ এন-লাইয়ের কাছ থেকে ঝাড় খেয়েও দেশে ফিরে সেসব সাধারণ কমরেডদের থেকে গোপন করে সিএম এর বন্দনায় নোট্স্ লিখলেন?
---- সে কথা বললে অনেকটা দায় তো চীনা পার্টির ওপরেও বর্তায়। রেডিও পিকিং আর পিপলস্ ডেইলি তো সমানে ভারতের আকাশে 'বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ' বলে চেঁচিয়ে আমাদের মাথা খারাপ করে দিল।
কিন্তু আজ আমি করে খাচ্ছি। বৌ-মেয়েদের নিয়ে সংসার করছি। অথচ প্রিয়ব্রত নেই। বিধবা মায়ের একমাত্র সন্তান। আর আমার সাহস নেই ওঁর সামনে গিয়ে দাঁড়াবার। নে, এই তো হাল তোর এক ঘোড়সওয়ারের। ভাল করে দেখে নে-- ঘোড়া থেকে পড়ে গিয়ে শিরদাঁড়া ভেঙে গেছে।
শংকর হাসল না মুখ ভ্যাংচাল বোঝা গেল না।
-- এবার সজলের কথা বলবি? আমাদের নিজে নিজে হাঁপানির ইঞ্জেকশন নেওয়া গুয়েভারার কথা?
--- কিছু বলার নেই। ওর গল্পে "মোটরসাইকেল ডায়েরি"র মত কোন রোম্যান্টিক স্বাদ নেই, নাটকীয়তা নেই। বর্ধমানের গলসি না কাঁকসা কোথা থেকে যেন ধরা পড়ে। জেলে মার খায়, ভূখ হরতাল করে। হাঁপানির রোগী। রাত্তিরে টান ওঠে। ভোরবেলায় জেলের হাসপাতালে পাঠানো হয়। ততক্ষণে অক্সিজেনে কম হয়ে যাওয়ায় টেঁসে গেছল।
-- ওর বাবা-মাতো আগেই বাংলাদেশে মারা গেছলেন। এখানে জ্যাঠার বাড়িতে থেকে পড়াশুনো করত। আর জ্যাঠার ছিল সুদের আর বন্ধকীর কারবার। সেই নিয়ে একবার চোপা করায় উনি সজলকে বাড়ি থেকে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করেছিলেন।
--- হ্যাঁ, আমাদের মধ্যে ওই বোধহয় সবচেয়ে আগে ঘরের মায়া ছেড়ে পথে নেমেছিল। তোর ফেরারি ফৌজের তিনজন অশ্বারোহীকে তো দেখলি। লিস্টির দুজন মৃত। এবার কাকে কাকে দেখতে যাবি?
--- সৌম্যদাকে।
--যাস না, গিয়ে লাভ নেই।
--কেন?
--ভুল দরজায় কড়া নাড়া হবে।
-- মানে?
--- ও রেনেগেড; বেইমান দলত্যাগী।
-- এই তো তোদের দোষ। মতে না মিললেই রেনেগেড! ছাড় তো এসব! বড় হ! সৌম্যদা কি মিদনাপুর জেলে দুবছর কাটিয়ে আসে নি? ও কি তোদের মত ঘর ছেড়ে গাঁয়ে যায় নি? কৃষকের ঘরে একবেলা পান্তা খেয়ে অন্য বেলা জল খেয়ে পেট ভরায় নি? তবে?
শংকর আস্তে আস্তে মাথা নাড়ে।
-- ওসব ঠিকই বলছিস। কিন্তু ওটাই সবটা নয়। বলছি, শোন তা'লে। সৌম্য বানচোত হচ্ছে একটা ইঁদুর! ধাড়ি ও নয়, নেংটি ইঁদুর।
-- কী যা তা বলছিস?
-- ঠিকই বলছি রে! দেখ, জাহাজ ডোবার সংকেত সবার আগে কারা টের পায়?--ইঁদুরেরা। সৌম্য হল সেই জাত। ও আগেই টের পেয়েছিল যে আমাদের জাহাজ ডুবছে। আমরা কিছুই বুঝিনি। তখন চাকুলিয়া আর মাগুরজানে মিলিটারি পুলিশ ক্যাম্পে সফল অ্যাকশনের আনন্দে রায়বেঁশে নাচছি।
ও বাড়িতে খবর পাঠাল। বাবা-কাকারা পুরনো কংগ্রেসি। সেখান থেকে পলিটিক্যাল প্রেশার এল। নিজে জেলারের সঙ্গে লাইন করল। একদিন দেখলাম ও আমাদের সেল থেকে সরে গেছে। তখনও বুঝতে পারিনি। ওর কী হবে ভেবে ভয় পেয়েছিলাম। পরে দেখলাম ও জেলের রাইটার না কি যেন হয়ে গেছে, গ্র্যাজুয়েট ছিল তো! হাতখরচা পেল, ভাল খাওয়াদাওয়া।
-- সে কি রে! সৌম্যদা রাইটার?
-- আশ্চর্য্যের কি আছে? আসলে বয়সে বড় বলে দাদা বলতাম, সম্মান দিতাম। কিন্তু ও ছিল হামবড়া কথার ফুলঝুরি। চটকদার ও হাসির কথা বলে আমাদের মত কমবয়েসিদের ইয়ার হয়ে যেত, কিন্তু মানুষটা ছিল ভেতরে ভেতরে ছ্যাবলা।
আমি হেসে ফেলি।
-- ঠিক বলেছিস , ও ছিল মহা বাতেলাবাজ।। সেটা মনে আছে? সেই যে ওদের পোড়ো বাগানে আর ক্ষেতে কাজ করতে কিছু সাঁওতাল লেবার এসেছিল আর ও ইউনিটের আড্ডায় বলল-- সাঁওতালদের বলেছি দিনের বেলায় ঠেসে ঘুমোতে আর রাত্তিরে আমাদের মোমবাতির আলোয় তির চালানো শেখাতে। মজুরি পুরো পাবে।
এবার দুটো মাস অপেক্ষা করুন কমরেড্স্। মাত্র দুটো মাস। তারপর একদিন সকালবেলায় কোলকাতার ভদ্রজনেরা চায়ে চুমুক দেওয়ার আগে খবরের কাগজ খুলে চমকে উঠবেন। লুঙ্গিতে গরম চা ছলকে পড়বে। সমস্ত কাগজের প্রথম পাতায় ব্যানার হেডলাইন--" নকশালবাড়ির তির নাকতলায়"।
ও আমাকে টিউশন পাইয়ে দিয়েছিল বাতেলা মেরে। আমাকে গুরুমন্ত্র দিল-- বেশি পড়াবে না। ঘন ঘন টেস্ট নেবে। সেই সময়টা ছাত্রের মার সঙ্গে গল্প করে কাটাবে। ব্যস্, কেল্লা ফতে। টেস্টের ভয়ে ছাত্র নিজেই কষে পড়বে আর নাম হবে তোমার। এদিকে বাচ্চার মা খুশি হলে পাবে মুখরোচক সব জলখাবার।
আর মনে আছে --প্রেসি ও যদুপুরের কমরেডরা রিসার্চ করে এমন বোম বানিয়েছে যে তুমি আমি পোঁদ চেপে বসলেও কিছু হবে না। কিন্তু সিপিএম এর দীপু বসল কি---।
কিন্তু সেবার বেলেঘাটায় খুব মার খেল না সিপিএম এর হাতে! সেই যে রে ---সিপিএম এর জাঁদরেল নেতা কে জি বসুর শালা খোকন নকশাল হয়ে নিজের জামাইবাবুকেই সব জায়গায় বেয়াড়া সব কোশ্চেন করে কাঠি করতে লাগল--- তখন বেলেঘাটার সিপিএম ক্যাডারা দুজনকেই পেঁদিয়ে বিন্দাবন দেখিয়েছিল। তখন সৌম্যদারও দুটো দাঁত পড়ে গেছল চ্যালাকাঠের বাড়ি খেয়ে।
--- আর বামপন্থী নাটক করার সময়েও নিজেই পরিচালক আবার নিজেই হিরো।
--- ও হো! তোর সেই খার অ্যাদ্দিনেও যায় নি? সেই চালের ব্ল্যাক ধরা নিয়ে পথনাটিকা! বাসভাড়া ও প্রত্যেক দিন পাঁচটাকার কড়ারে পেশাদার নায়িকা এলেন। রিহার্সাল চলছিল। মেয়েটার ইচ্ছে ছিল বিপ্লবী হিরোর রোল তুই করবি, কিন্তু শেষ সময়ে--।
--ছাড় ওসব কথা। মোদ্দা ব্যাপার হল সৌম্য আদৌ অশ্বারোহী নয়। ও হল খচ্চরবাহন। ছোটবেলার প্রেমিকাকে বিয়ে করে 'সুখী গৃহকোণ, শোভে গ্রামোফোন' গোছের সংসার করছে। আমার পুরনো কাসুন্দি ঘাঁটার কোন ইচ্ছে নেই।
--- তা বেশ। কিন্তু একটা ব্যাপারে ধন্দ মিটছে না।
--কোন ব্যাপারে?
-- আমার ইংরেজির মাস্টারমশায় দীনেন স্যার! তুই বলছিস, বিজনদাও বললো, মানে ঘটনাটা সত্যি। কিন্তু কেন ঘটলো তার একটা ব্যাখ্যা থাকবে তো? অমন সাদামাটা নিরীহ গোছের ভ্দ্রলোক কেন দলত্যাগী বলে চারটে ছেলেকে মৃত্যুদন্ড দিলেন? কেন নিজের প্রাক্তন ছাত্রের নামে মিথ্যে ডায়েরি করলেন? এটার কোন ব্যাখ্যা তোদের কাছে আছে? ওই বেড়ালের পোঁদে ফুঁ দিয়ে বাঘ বানানো ঠিক যুক্তি হল না।
--- আছে, ব্যাখ্যা আছে। কাকোল্ড কথাটার মানে জানিস তো?
-- জানি, যার স্ত্রী অন্যের প্রেমিকা। ওই খানিকটা কাকের বাসায় কোকিলের ডিম পাড়া গোছের সিনড্রোম।
-- উনি ছিলেন কাকোল্ড।
-- সে একটা কোলকাতা ছাড়ার আগে শুনেছিলাম বটে! ওঁর অল্পবয়েসী স্ত্রীকে নিয়ে অনেকে রসালো মন্তব্য করত, ছেলেরাও। আমার রুচিতে বাঁধত। হয় প্রতিবাদ করেছি, নয় স্থানত্যাগ করেছি। কিন্তু একজন ক্রিশ্চান স্যার ছিলেন, গ্রামার পড়াতেন। জ্যাকব সার। উনি বৌদিকে নিয়ে কবিতা লিখতেন শুনেছি। ও'রম একটু আধটু ফ্লার্ট!
-- ব্যাপারটা অনেক দূর গড়িয়েছিল। রোজ ঘরে এসে সময়ে অসময়ে সহকর্মী বৌকে লাইন দিচ্ছে, সবার সামনে। আর স্ত্রীও প্রশ্রয় দিচ্ছেন --কাঁহাতক সহ্য করা যায়। কিন্তু বৌদি বেশ টেঁটিয়া। একদিন স্বামী-স্ত্রীর তিক্ত তর্কাতর্কির পর উনি টিক-২০ খেলেন। এমন মেপে খেয়েছিলেন যে মরবেন না, কিন্তু হাসপাতালে ভর্তি হবেন।
খবর শুনে গিয়ে দেখি স্যার ময়লা গেঞ্জি আর ধুতি পরে তালপাতার পাখা নেড়ে উনুন ধরাচ্ছেন আর ছোট ছোট দুটো বাচ্চা খিদেয় কাঁদছে। খুব খারাপ লাগল। গিয়ে আমার গার্লফ্রেন্ডকে পাঠালাম। ও গিয়ে স্যারকে সরিয়ে ভাতে ভাত, ডাল আর দুটো তরকারি রান্না করে দিল।
এই ঘটনার পর স্যার গুম মেরে গেলেন। বৌদি হাসপাতাল থেকে ফিরে আরও বেপরোয়া হয়ে উঠলেন। জ্যাকব স্যারের সঙ্গে এখানে ওখানে গিয়ে আলাদা করে দেখা করতে লাগলেন। আর দীনেনস্যারের ঘর-গেরস্তি সবার কাছে হাসির বস্তু হয়ে দাঁড়াল।
এই হিউমিলিয়েশন দুর্বল ব্যক্তিত্বহীন পুরুষের অপবাদ বা ইঙ্গিত ওঁর ভেতরে বারুদ পুরে দিল। ফলে রাজনৈতিক হিংস্রতার দিনে যখন ওঁর কাছে ডিসিশন চাওয়া হল উনি একেবারে নির্মম এক অবতারের রূপ ধরলেন। নৃসিংহ অবতার।
না, উনি নিজের কাজের জন্যে এতটুকু অনুতপ্ত ছিলেন না। কিন্তু ভায়োলেন্স এক দুধারি তলোয়ার--সেটা বুঝতে পারেন নি। তাই সিদ্ধার্থ রায়ের যুব কংগ্রেসের হামলার দিনে চুপচাপ সপরিবারে পাড়া ছেড়ে যাওয়ার সময় ওঁর চোখের মধ্যে ঠিক আতংক নয়, কেমন হতাশার ছাপ ছিল।
১০)
হাতে রইল পেনসিল
----------------------
হারাধনের ছিল দশটি ছেলে। নয়জন গেল কালের কবলে-- এক এক করে। শেষ ছেলেটি বোধহয় যমের অরুচি, তাই বেঁচেবর্তে রইল হারাধনের বংশের কুলপ্রদীপ হয়ে। কিন্তু সে পিদিমেরও তেল ফুরিয়ে গেছে। তাই যা হবার তা হল। প্রথমে ভেউ ভেউ করে খানিক কেঁদে নিল।
তারপর ?--' মনের দুঃখে বনে গেল রইল না আর কেউ'।
সে না হয় হল। কিন্তু আমরা ছিলাম আটজন, আট অশ্বারোহী। আমাকে বাদ দিয়ে ওরা সাতজন। না, মনের দুঃখে বনে যাই নি। এখনও ব্যাট করছি।
কিন্তু সে তো টেল-এন্ডারের ব্যাটিং! একে নাইট -ওয়াচম্যান।তায় ফলো অন বাঁচানোর চাপ।তাই অন্যদিকে কে কে টিঁকে আছে খোঁজ নিতে বেরিয়েছি।
কেন? উত্তর নিজেরও জানা নেই। শুধু ফলো অন নয়, একেবারে ইনিংস ডিফিটের ভয়। স্ট্র্যাটেজি যে ভুল ছিল সে তো বহু আগেই বুঝে গেছি। আসলে ক্যাপ্টেন টস জেতায় আমরা ভেবেছিলাম যে খেলাটাই জিতে গেছি।
তো সাতজনের খোঁজ পেয়েছি। আসলে তিনজন। বিজনদা, শংকর আর বিমলে। দুজন বীরগতি প্রাপ্ত হইয়াছেন-- সজল ও প্রিয়ব্রত। একজন রেনেগেড আখ্যা লাভ করিয়াছেন--সৌম্যদা।
রইলাম শুধু আমি।
আমি মুক্তপুরুষ।বৌ ও দুইসন্তান আমার সম্বন্ধে অনাস্থা প্রস্তাব পাশ করিয়াছে। ফলে মন-বলে-আর-কেন-সংসারে-থাকি কেস!
কিন্তু একী হইল! ব্যাংকে কর্ম করিয়াও আমি পাটিগণিতে কাঁচা! যাদববাবু বা কে সি নাগ-- উভয়েরই স্নেহ হইতে বঞ্চিত। দুই আর দুইয়ে কত হয় জানিতেও ক্যালকুলেটরের বোতাম টিপিতে হয়! তাই খেয়াল করি নাই যে সাকুল্যে সাতজন হইয়াছে। একজন এখনও বাকি। অলকেশ। আমাদের সর্বকনিষ্ঠ ঘোড়সওয়ার। সে আজ কোথায়?
শীতটা বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে।
এতদিনে।
এবার তো নভেম্বরের বিকেলেও সোয়েটার চড়াতে হয় নি। এখন ক্রিসমাস হাতছানি দিচ্ছে। একটা চোরাগোপ্তা উৎসব উৎসব ভাব। সূর্যডোবার আগেই আমার দু'কামরার আস্তানার দরজায় তালা ঝোলাই।
হেঁটেই চলে যাবো মেট্রো স্টেশন গীতাঞ্জলি।হাজরায় একবন্ধুর ঠেকে ডানহাতের ব্যাপার ও কিছু কাজের কথা সেরে ফিরতে হবে বিজনদার ঘরে। একটা প্যাকেট নিয়ে আসতে হবে। কিসের প্যাকেট খোলসা করে বলে নি। মরুক গে! কিছু একটা হবে।
তবে আমার মতলব আলাদা। আমি খোঁজ চাই অলকেশের। বিজনবুড়োকে খোঁচালে কোন সুলুক সন্ধান নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে।
পকেটে চাবি, মোবাইল আর এটিএম কার্ড আছে তো! হাত ঢুকিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে যাই।
সিঁড়ি দিয়ে নামছি কি রামবিরিজের সঙ্গে দেখা। এই সাদামাটা ফ্ল্যাটবাড়ির একমাত্র সিকিউরিটি গার্ড ও ম্যানফ্রাইডে।
আমাকে দেখলেই ওর মুখে কেমন একটা বাঁকা হাসি ফুটে ওঠে। ছোটবেলায় যুগান্তর পত্রিকায় কাফি খাঁর কার্টুনে এমনি এক মুখভঙ্গী দেখেছিলাম --নাপিতের চেহারায়। তার সঙ্গে ছিল দু'লাইন ছড়া।
"ক্ষুর ঘষন্তি ক্ষুর ঘষন্তি চিড়িক চিড়িক পানি,
তোমার যা মনের কথা সে তো আমি জানি"।
হতভাগা! ও কী জানে?
আমার মনের কথা ও কী জানে!!
--চললেন রমেনবাবু? এগারটার মধ্যে ফিরবেন তো?
-- মানে?
-- জাড়া বহোত হ্যায়। আমি এগারটার পরে গেটে তালা লাগিয়ে শুয়ে পড়ি। বুড়ো হয়েছি। ঠান্ডা সয় না। তবিয়ত খারাপ হয়ে যায়।
-- চিন্তা কর না। তুমি তোমার হিসেবে শুয়ে পড়। আমি এগারটা বাজলে অন্য বাড়িতে থেকে যাবো।
-- রাগ করলেন বাবু? আসলে--।
আমি উত্তর না দিয়ে বেরিয়ে যাই। এসব ওর ভড়ং। সোসাইটির প্রেসিডেন্টের আশকারা পেয়ে মাথায় চড়েছে। ও অন্যদের গাড়ি ধুয়ে দেয়। বাজার করে দেয়।বকশিশ পায়। আমার ওসব বালাই নেই। ফলে ওর চোখে আমি মহাফালতু লোক।
আদ্দেক রাস্তা পেরিয়ে এসেছি সামনেই শ্রীগুরু আশ্রমের গেট। আর একটু এগোতেই থমকে দাঁড়াই। ওই ছোট্টমত ক্লাবের সামনে এই ভিড় কিসের?
বর্তমান সরকারের বদান্যতায় ক্লাবে ক্লাবে ছয়লাপ। গলিতে গলিতে ক্লাব। সবাই সগর্বে ঘোষণা করে যে ওরা সরকারের ক্রীড়া ও যুবকল্যাণ দপ্তরের সৌজন্যে দু'লাখ টাকা করে পেয়েছে।
ভিড়টা অমনি এক ক্লাবের বিপরীতে বাঁধানো চাতালের সামনে।কিছু চ্যাংড়া ছোঁড়া কাউকে ঘিরে হো-হো করে হাসছে। সঙ্গে স্ট্যান্ডের জনাচারেক রিকশাওয়ালা।
আমি পাশ কাটিয়ে যাবার চেষ্টা করি।
তবু দাঁড়িয়ে পড়তে হল। কানে এসেছে এক মহিলার কন্ঠস্বর। উনি কাউকে অনুনয়- বিনয় করছেন। কিন্তু ওই গলার স্বর যে আমার চেনা!
ভিড়ের মাঝে উঁকি মারি।
হ্যাঁ, অনুনয়মাখা গলার স্বরের মালকিনকে আমি চিনি। আমার ফ্লোরে একটা ফ্ল্যাট বাদ দিয়ে দ্বিতীয় দরজাটি। দরজায় কার্সিভ হস্তাক্ষরে লেখাঃ
কৃষ্ণা মাইতি, এম এ ;
সুধীর মাইতি, পি এইচ ডি।
উঠতে নামতে চোখাচোখি হয়েছে, আলাপ হয় নি। কোন স্কুলে পড়াতে যান। একবার আমার দরজায় বেল টিপে আমার ইস্ত্রি করা কাপড় দিয়ে গেছিলেন, আর একবার ডাকে আসা কিছু কাগজপত্র।
সেদিন এসেছিলেন জানতে যে ফ্রিজ সারাইয়ের কোন দোকানের ফোন নম্বর জানা আছে কি না।
রামবিরিজের সূত্রে খবর পেয়েছি যে সুধীরবাবু হটাৎ একদিনের জ্বর ও মাথাব্যথায় গত হয়েছেন। বছর দুই হল। উনি এখন একাই থাকেন। ছেলে মুম্বাইয়ে।
কিন্তু ওঁর গলার স্বর! নারীকন্ঠের হিসেবে একটু মোটা ,তবে জোয়ারিটা বড্ড মিঠে। তাই ভিড়ের মধ্যে ওঁর অনুনয়ও আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে।
কিন্তু উনি বারবার রিকোয়েস্ট করছেন কাকে? ওই ছোকরাগুলোকে? কেন? ওরা কি ওঁকে ভরা বিকেলে খোলা রাস্তায় বিরক্ত করছে?
কালে কালে হল কী!
প্রতিবেশিনীর প্রতি কর্তব্যবোধে সচেতন হয়ে এগিয়ে গেলাম।
কী হয়েছে, ভাই?
যা হয়েছে তার মাথামুন্ডু বুঝতে বেশ সময় লাগল।
শানবাঁধানো রকে বসে এক থুড়থুড়ে বুড়ি। ধপধপে সাদা চুল ছোট করে ছাঁটা। পরনে সাদা থান, গায়ে একটা হাল্কা উলের ব্লাউজ। পাশে একটা থলি মত, আর আধখালি জলের বোতল। একে চলতে ফিরতে কয়েকবার দেখেছি। সকাল বেলা হাঁটি হাঁটি পা পা করে রোয়াকে এসে বসেন আর সূর্য ডুবলে পরে উঠে কোথায় যেন চলে যান। কারো সঙ্গে কথা না বলে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকেন। চারপাশের লোকজন দোকানপাটের বিষয়ে যেন উদাসীন ।কখনও হাসতে দেখিনি। এতদিন পাগল ভেবে এড়িয়ে গেছি।
তাঁর সামনে হাঁটু গেড়ে বসেছেন আমার প্রতিবেশিনী। সামনে নামিয়ে রেখেছেন এক বোতল দুধ, কিছু ফল আর প্লাস্টিকের টিফিন কৌটোয় কিছু রুটিতরকারি।
কিন্তু বৃদ্ধা নির্বিকার পাথরপ্রতিমা।
--মাসিমা, কিছু মনে করবেন না। রোজ দেখি শীতের মধ্যে একা একা এমনি খোলা জায়গায় বসে থাকেন। এই উলের ব্লাউজটা নিন, বেশ গরম। আর এই প্যাকেটে দুটো শাড়ি।
বৃদ্ধা অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন।
--- মাসিমা, আমি আপনার মেয়ের মত। প্লীজ, এগুলো নিন। আর এই এক প্যাকেট বিস্কুট, সামান্য ফল, আর এই টাকাটা রাখুন।
টাকার কথা কানে যেতেই বৃদ্ধা চমকে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লেন। আধবোজা উনুনে যেন আবার আঁচ বেড়ে উঠছে। জোড়া হাত কপালে উঠলো।
--ধন্যবাদ! আপনি কে জানি না। কিন্তু এসব কিছুই আমি নিতে পারবো না। দয়া কইরা ফেরত নিয়া যান।
--কী বলছেন মাসিমা?
-- ঠিকই শুনেছেন। আপনার দয়া দেখানোর কুনো দরকার নেই। আমি খুব ভালো আছি। আপনে যান।
আমার প্রতিবেশিনী কৃষ্ণা ম্যাডাম এই রূঢ় প্রত্যাখানে অবাক হয়ে ফ্যালফ্যাল করে এদিক ওদিক দেখছেন। আমাকে যেন দেখেও দেখলেন না। শেষে তামাশা দেখা ছেলের দলকে ধরলেন।
-- ভাই, আপনারা একটু বোঝান না! উনি কেন অমন করছেন?
--- কাকিমা, কোন লাভ নেই। অমন আড়বুঝ বুড়ি এ তল্লাটে নেই। নিজের ভালো পাগলেও বোঝে। উনি বোঝেন না।
-- উনি রেগে যাচ্ছেন কেন? আমি কি অন্যায্য কিছু বলেছি? আজ আমার স্বামীর বার্ষিকী। এই সময় প্রতি বছর এসব করে থাকি। এমন অভিজ্ঞতা কখনও হয় নি।
--- আরে উনি ওইরকমই।
এবার আমি একটু নাক গলাই।
-- শুনুন মাসিমা। আপনি থাকেন কোথায়? বাড়িতে কে কে আছে? রোজ ঠান্ডায় এমনি করে খোলা জায়গায় বসে থাকলে নিমোনিয়া হতে পারে। চলুন,আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি।
-- ধন্যবাদ! আমার কারো সাহায্যের দরকার নেই। এসব হইল জুতা মাইরা গরু দান।
এবার আমার হতভম্ব হওয়ার পালা।
--মানে?
-- আপনেরা কিছুই জানেন না। এই ছোকরাগুলান জানে। ওই যে রাস্তার অইপারে যেখানে অগো নতুন ক্লাব ঘর উঠতাছে--সেইটা ছিল আমার জমি। সোয়ামি নাই, ছেলে এখানে থাকে না। কিন্তু অরা আমার ঘর ভাইঙ্গা দিছে, জমিন কাইড়া নিসে। আমারে নিঃস্ব করছে। এখন আপনেরা আইছেন দয়া দেখাইতে? কুনো দরকার নেই। আমি মরলে ওই ফলমূল ট্যাহা দিয়া আমার ছেরাদ্দ কইরেন, এখন যান।
আমি শ্বাস টানি। একনজর ছেলেগুলোকে দেখি। ওরা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমাকে জরিপ করছে।
আমি মাপা পায়ে ওঁর কাছে গিয়ে কৃষ্ণাকে সরিয়ে উবু হয়ে বসি।
--মাসিমা, আপনার কাছে ওই জমির কোন কাগজ বা দলিল আছে? ধরেন কর্পোরেশনে ট্যাক্সের রসিদ? যা দেইখ্যা সবার বিশ্বাস হইব যে জমিনটা আপানর ছিল।
বলামাত্র ক্লাবের ছেলেগুলো হা-হা করে হেসে উঠল।
-- আপনে কি উকিল নাকি মেসোমশায়? ওসব আগেই অনেকে চেষ্টা করেছে। ওঁর গল্পটা সত্যি নয়। এসব বুড়ো বয়সের ভীমরতি।
আমি মুচকি হাসি। ওদের দলটাকে স্ক্যান করে চশমা পরা ছেলেটিকে বলি-- না, উকিল-টুকিল নই। জানতে চাইছি ব্যাপারটা কী? তোমাদের সঙ্গে এনার কিসের ঝগড়া?
ওদের চোখের সম্মিলিত চাউনি নরম হয়।
চশমা পরা ছেলেটি বলে --এবার লাইনে এসেছেন কাকু। আমাদের দিকটা শুনে নিন। আমরা অত খারাপ লোক নই।
-- না কাকু! এই দিদার জমি বা এক ইঁটের খুপরি ঘরটি ছিল সরকারি জমির উপর জবরদখল করে। তাই ওঁর কাছে কোন কাগজ বা পাট্টা নেই। থাকতে পারে না।সে দিক দিয়ে দেখলে ওই জমির উপর ওঁর কোন আইনি হক নেই।
-- আপনিই বলুন কাকু, যখন করপোরেশন রাস্তার উপর জবরদখলি দোকান ভেঙে দেয় তখন কিসের জোরে ভাঙে। বে-আইনী বলেই তো!
আমি গলা খাঁকরি দেই।
-- এটা কি সত্যি যে তোমাদের নতুন ক্লাবঘর ওই মহিলার ভিটের ওপর তৈরি হচ্ছে? যদি তাই হয় সেটাও তো একরকম সরকারি জমিতে দখল, বেআইনি ভাবে। তাই তো?
-- না কাকু! আমাদের পাট্টা আছে। ওই জমির টুকরোটি আমাদের ক্লাব সরকারের থেকে লীজ নিয়েছে, রেজিস্ট্রি করে। পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়ে। হ্যাঁ, এই সরকারের থেকে যে দু'লক্ষ টাকা অনুদান পেয়েছি তার থেকেই, বাকিটা ক্লাবঘর তৈরিতে লাগছে।
-- কিন্তু জবরদখল জমিবাড়ি ভেঙে দিলেও আইনি ক্ষতিপূরণ দেবার বা বা পুনর্বাসনের ব্যব্স্থা আছে না? আর এই দিদার বয়েসটা দেখ!
-- বলেছি না আমরা অমানুষ নই। আসুন, ওই দেখুন, পেছনের জমিতে অ্যাসবেস্টসের ছাদ আর এক ইঁটের দেওয়াল দিয়ে দিদার জন্যে আমরা একটা থাকার জায়গা করে দিয়েছি। ক্লাব থেকে তার টেনে একটা বাল্ব ও লাগিয়ে দিয়েছি। দেখবেন আসুন।
ওরা খুব একটা বাড়িয়ে বলেনি।
ঘরের মধ্যে একটি নেয়ারের খাটিয়ায় বিছানা করে কম্বল পেতে মশারি টাঙিয়ে দেওয়া আছে, কোণে একটি জলের কুঁজো ও গেলাস।
কিন্তু দিদা যে ওই ঘরে যেতে চায় না!
ফিরে যাই ওই বৃদ্ধার কাছে।
-- মাসিমা, ছেলেগুলো আপনার নাতির মত। আপনাকে ভালবেসে ভাল ব্যবস্থা করেছে। কেন অভিমান করে মুখ ফিরিয়ে আছেন। আমার হাত ধরুন। সন্ধ্যে হয়ে এল। ঠান্ডা বাড়ছে, চলুন-- আপনার ঘরে নিয়ে যাই।
উনি আমার দিকে এক অদ্ভূত চোখে তাকিয়ে রয়েছেন, পলক পড়ছে না; এক মিনিট । শেষে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন-- তোমারে বুঝাইতে পারি না। আমার ভিতরটা জ্বইল্যা যায়। ওরা ভাল ঘর ভাল বিছানা দিছে। কিন্তু সেই ঘরে আমার সোয়ামির গায়ের গন্ধ কই? আমার ছেলের ছোটবেলার মুতের কাঁথার ঝাঁঝ কই? কইলাম তো, কারো দয়া চাই না। এই বুড়া হাড় কয়খান জুড়াইতে আর বেশি দিন নাই। পারলে আমারে আগের জায়গাতেই মরতে দাও। আর না পারলে দূর হইয়া যাও, মাগনা কুয়ারা কইরো না!
১১)
নীল সাদা শাড়ি, নীল রঙা ডায়েরি
-----------------------------------
সেদিনের সন্ধ্যেতে এক অচেনা বুড়ির বেয়াড়া জিদের কাছে হার মেনে ঘরে ফিরে এসেছিলাম। রাত্তিরে খেতে ইচ্ছে করছিল না।মুখের ভেতরে লংকাবাটার স্বাদ।
কেন যে মানুষকে সুখে থাকতে ভূতে কিলোয়! বুড়ি বৈতরণী পেরোবে বলে এক পা বাড়িয়েই রয়েছে , তবু জমি নিয়ে জিদ গেল না। খামোকা কষ্ট পাচ্ছে। শুধু বেয়াড়া জিদের জন্যে। ফালতু ইমোশনাল অত্যাচার।
একটুকরো জমি মানে একটুকরো জমিই, তার বেশি কিছু নয়। তবু তার মধ্যে ও সোয়ামির গায়ের গন্ধ, খোকার ছোটবেলার পেচ্ছাপের ভিজে কাঁথার ঝাঁঝালো গন্ধ খুঁজে বেড়াচ্ছে। যত্তসব পাতি সেন্টু।
ঠিক যেন নন্দীগ্রাম সিঙ্গুরের চাষী। ওদেরও সেই পাতি সেন্টিমেন্ট। আরে বাবা, তখন যদি টাটকে ওরা হাসিমুখে জমি দিয়ে দিত তো আজকে সিঙ্গুর আর অজ পাড়াগাঁ না থেকে একটি চিত্তরঞ্জন বা দূর্গাপুর, নিদেনপক্ষে একটা বেলঘরিয়া -টিটাগড় হয়ে যেত। পাতি সেন্টিতে সুড়সুড়ি দিয়ে বিরোধীরা ওদের হাতে তামাক খেয়ে গেছে, দোষ দেবে কাকে! ওরা তো আর পোঁছেও না।
এখন মরগে যা!
'ভালো রে ভালো করে গেলাম কেলোর মার কাছে,
কেলোর মা বললে আমার ছেলের সঙ্গে আছে।
যখন তোরা এত বছরের পুরনো দল ছেড়ে মা-মাটি-মানুষের নামে নেচে উঠেছিলি তখনই বলেছিলাম
--আজ বুঝবি নে, বুঝবি কাল,
পোঁদ চাপড়াবি পাড়বি গাল'।
এসবই হল কালীদার কথা। আমাদের বাঙালপাড়ায় একজন খাস ঘটি। মোহনবাগানের সাপোর্টার।ও নাকি এ পাড়ার আদি বাসিন্দা কোন খানদানি জোতদার পরিবারের ছেলে। মাথাটা গেছে। কিন্তু আমরা ভালবাসি, কালীদা বলি। কেউ ওকে পাগল বলে খোঁচালে তাকে মারতে বাকি রাখি। কষে গাল দিয়ে ভূত ভাগিয়ে দিই।
সে যুগে কাকদ্বীপ না কোথাকার সম্পন্ন বাড়িতে ওর বিয়ে ঠিক হয়। তখন ওর বয়েস বাইশ, বিয়ের আসরে ও চেঁচিয়ে ওঠে-- এ বিয়ে করবুনি, লিচ্চয় করবুনি। এরা ঠকিয়েছে। আমাকে অন্য মেয়ের ফটু দেখিয়েছিল।
মেয়ের বাবা দিব্যি গেলে বললেন-- আমার একটিই মেয়ে। ওর ফটুই দেখেছিলে বাবা। হ্যাঁ, সে ফটু কোলকেতার পার্ক স্ট্রিটের সায়েবি দোকানে তোলা, সেটা মানছি।
সবার পেড়াপিড়িতে কালীদা বিয়ে করে ফিরে এল বটে, কিন্তু গুম মেরে রইল। তারপর মাথায় ছিট দেখা দিল। বৌ বলল এসব আমাকে লুকনো হয়েছে। আমিই ঠকেছি। তারপর গয়নাগাটি কাপড়জামা নিয়ে বাপের বাড়ি চলে গেল। বরাবরের মত।
এবার মাথার ছিট বিঘৎখানেক থেকে গজখানিক হল।
পাবলিক মেনে নিল যে কালী হল মহাপাগল। কারণ ও ছিল ছোটদের খিস্তিমাস্টার। পয়সা নিয়ে খিস্তি করতে শেখাত। আমি ছিলাম এক মনোযোগী ছাত্র।
আমতলার ঠেকে আসত কালীদা।
এসেই হাত পাতত-- দে না চার আনা। এক প্লেট ঘুগনি খাব, অধীরের দোকানের। বড় ভালো বানায়।
কেউ প্রথমে গা করল না দেখে বলল,
--রমেন কোথায়? ও তোদের মত না, ঠিক পয়সা দেবে।
সবাই হেসে উঠত।
-এই যে কালীদা তোমার রমেন। তোমাকে দেখে মুখ লুকোচ্ছে।
অগত্যা আমাকে এসে কালীদার হাতে চার আনা বা পঁচিশ নয়া পয়সা গুঁজে দিতে হত।
একগাল হাসি নিয়ে কালীদা শুরু করল।
--এই ধাঁধাটা বল দেখিঃ
হেসে হেসে গেল মেয়ে পরপুরুষের পাশে,
দেয়ার সময় উহু-উহু, দেয়া হলে হাসে।
আমাদের বাকরুদ্ধ অবস্থা দেখে মিটিমিটি চোখে বলল--যা ভাবছিস তা নয়, এ হল শাঁখারির শাঁখা পরানো। মেয়েরা হাসি মুখে শাঁখা পরিয়ে দিতে বলে। কিন্তু হাত মুচড়ে একটু একটু করে চাপ দিয়ে পরানোর সময় লাগে বই কি, হয়ে গেলে খুশ।
--রাখো তো কালীদা! ওসব মা-ঠাকুমার যুগের গপ্পো। আজকাল কোন মেয়ে শাঁখা পরতে শাঁখারির কাছে যায়?
কালীদা দমে না।
--বেশ, এটা বল।
দেখেছি মায়ের, দেখেছি বোনের, শালীরও হয়েছে দেখা,
কিন্তু বৌয়ের দেখতে যে পাব কপালে নেইকো লেখা!
--কী আজেবাজে ঘটি জোক্!
-- পারলি না তো! শোন।
উত্তরটা হল -বিধবার নিরাভরণ হাত। আমরা মায়ের বোনের বা শালীর বৈধব্যও দেখতে পারি। কিন্তু বৌয়ের বৈধব্য? দেখতে হলে তো আগে আমাকেই পটল তুলতে হবে।
কী যে ভাবছি! কোন মাথামুন্ডু নেই। রোদ্দূর উঠেছে, ঘুলঘুলি দিয়ে উঁকি মারছে। খিদে টের পাচ্ছি। কাল রাত থেকে খাইনি যে!
এবেলা মুড়ি খেয়ে কাটিয়ে দিলেই হয়। রাত্তিরে মোড়ের থেকে রুটি আলুরদম আনিয়ে নেবখন।
\দরজায় মৃদু খটখট। সাতসকালে কে এল রে বাবা! লুঙি ঠিক করে গায়ে একটা চাদর জড়িয়ে দরজা খুলে দাঁড়িয়ে পড়েছি।
প্রতিবেশিনী কৃষ্ণা মাইতি পি এইচ ডির বাঁ হাতে টি পট, ডান হাতে একটি ব্রাউন প্যাকেট।
আচ্ছা, ফরসা মেয়েদের নাম কেন কৃষ্ণা হয়, আর কালোদের গৌরী?
আর মাথায় ঘুরপাক দিয়ে বেজে উঠল ছেলেবেলার রেডিওতে শোনা অনুরোধের আসরের গান-- নীল শাড়ি তার অঙ্গে যেন আকাশ গঙ্গা ঝরা!
উনি বেশ সপ্রতিভ ভাবে প্রায় আমাকে ঠেলে ভেতরে ঢুকে পড়লেন।
-- আচ্ছা লোক তো মশাই। দরজায় কলিং বেল লাগান নি। সকালে একটি ছেলে, সম্ভবতঃ ক্যুরিয়র, ঠক ঠক করে হার মেনে এই প্যাকেটটা আমার ফ্ল্যাটে ছেড়ে গেছে। আর দুটো কাপ নিয়ে আসুন তো। এই শীতের সকালে একাসঙ্গে একটু চা খাই। আমার আবার একা একা চা খেতে ভালো লাগে না। সবার সঙ্গে সহজে মিশতে পারি না, বুঝতেই পারছেন। কিন্তু কাল থেকে তো আমরা বন্ধু হয়ে গেছি তাই না?
আমি বিনা বাক্যব্যয়ে আদেশ পালন করি।
(কে আবার বাজায় বাঁশি, এ ভাঙা কুঞ্জবনে!)
কিন্তু প্যাকেটের মোড়ক খুলে চমকে উঠি। একটি নীল রেক্সিনে বাঁধানো ডায়েরি, সঙ্গে বিজনদার হাতে লেখা চিরকুট।
রমেন,
তোর শেষ অশ্বারোহীর ডায়েরি। এতদিন আমার কাছে রাখা ছিল। তোকে দিয়ে হালকা হলাম।
বিজনদা।
ডায়েরির প্রথম পাতাতেই একটা আড়াআড়ি করে লেখা নোটঃ
"এই ডায়েরি যেন আমার মৃত্যুর পরে কমরেডরা পড়ে। "
অলকেশ রায়চৌধুরি,
১৭/১২/১৯৮৫
----- প্রথম ভাগ সমাপ্ত---

আরো পড়ুন
- 1
- 2
- 3
- 4
- 5