শিবাংশু
জং
"....হাওয়া বয় সন সন
তারারা কাঁপে।
হৃদয়ে কি জং ধরে
পুরানো খাপে।"
প্রেমেন্দ্র মিত্র ছিলেন চিরতরুণ। যাঁরা তাঁর সৃষ্টির সঙ্গে পরিচিত, সবাই জানেন। এই প্রশ্ন তো তাঁর মনেই আসবে। খাপ পুরোনো হলে কি হৃদয়ে জং ধরে যায়? কিন্তু কী করে তা ধরতে পারে? এই সন সন বয়ে যাওয়া হাওয়া, দূর দূরান্তে কেঁপে যাওয়া তারার আলো, তাতো জীবন্ত আবেগের ইশারা। জীবন থাকতে জং পড়বে কীভাবে। এই জীবন মানে শুধু শরীরে বেঁচে থাকা নয়। মানুষ to বাঁচে মনে। আমাদের সব খেলাই এই মন'টাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য।আকবর বাদশা থেকে হরিপদ কেরানি সবার জন্যই সত্য, এই নির্ণয়। সুনীল গাঙ্গুলিকে অনেকেই প্রশ্ন করতো। আপনি এই বয়সেও একুশ বছুরে ছেলেমেয়েদের গপ্পো এতো বিশ্বাস্যভাবে কীভাবে লিখে ফেলতে পারেন? তিনি বলতেন, আমি কখনও বুড়োদের সঙ্গে মেলামেশা করিনা। আমার নিজের বয়সীদের সঙ্গে কথা বলতে যাওয়া মানেই সেই প্রেশার-শুগার আর হাঁটুর ব্যথার গল্প। নয়তো বিমর্ষ দেশের হাল বা বিষাক্ত পরচর্চা। এগুলো'ই মানুষকে বয়সের আগেই আরো বুড়ো করে দেয়। তারা নতুন ছেলেমেয়েদের বুঝবে কী করে? কীভাবে তাদের মনের মধ্যে উঁকি দিতে পারবে?
-------------------
"....কার চুল এলোমেলো।
কী বা তাতে এলো গেলো !
কার চোখে কত জল
কে বা তা মাপে ?"
এই এলোমেলো চুল আর চোখের জলকে মনে রাখা। তাকে লেখার মধ্যে ধরে ফেলা। এই এলেমই তো শিল্পীর বেঁচে থাকার একটা বিশ্বস্ত সূচক। কবি-শিল্পীদের মূলধন তো সেসব অনুভূতিই। তাদের হাত ধরে যে যাত্রা, সেটাই লেখালেখির তীর্থপথ। কল্পনা আসলে অলীক। সত্যিকারের মানুষেরাই ভরে থাকে হৃদয়পুর। যারা লেখায় আসে তারা তো থাকেই। যারা আসেনা, তারাও। তাদের ছায়া চালচিত্রের মতো ঘিরে থাকে। তারা হয়তো নায়ক নয়, কিন্তু অনেক সময় তারাই অধিনায়ক হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু কীভাবে? নিজেকে লুকিয়ে কাজ করতে পারাই শিল্পীর সিদ্ধি। পাঠক-শ্রোতা-দর্শক সচেতনভাবে কিছু বুঝতে পারার আগেই শিল্পী তাঁদের ঘরে সিঁদ কেটে বসে থাকেন। বাজারশাস্ত্রের ভাষায় Selling the perception।
আমার এই লেখায় সুনীলের নাম নেবার প্রধান কারণ হলো কীভাবে তিনি নবীন প্রজন্মের কাছে নিজেকে দীর্ঘদিন প্রাসঙ্গিক করে রাখতে পেরেছিলেন, সেটা খোঁজার প্রয়াস করা। শিল্পী হিসেবে কেউ চিরজীবী হ'ননা, কিন্তু দীর্ঘজীবী হতে পারার কিছু মন্ত্র আছে। প্রেমেন্দ্রের কবিতাটি সেই মন্ত্র। সুনীল সেটি জীবনে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
মনে আছে একবার হায়দরাবাদে একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়েছিলো। তখন শুধু এপার নয়, ওপার বাংলারও অনেক বাংলাকবিরা হায়দরাবাদ এসেছিলেন শুধু কবিতার জন্য। সুনীল আসার আগে কলকাতাতেই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন, আমরা খবর পেয়েছিলুম। কিন্তু তিনি না আসতে পারলে গোটা আয়োজনটাই শিবহীন যজ্ঞ হয়ে যাবে ভেবে হয়তো অসুস্থতাসহ হাওয়াই জাহাজে চেপে যান। মাঝ আকাশেই অসুস্থ বোধ করছিলেন। এয়ারপোর্টে নেমে আর হেঁটে বেরোনোর অবস্থায় ছিলেন না। চাকাগাড়িতে চড়ে যখন তিনি নেমে এলেন, তখন তাঁর রীতিমতো আপাত অবস্থা। আমরা বেশ উদ্বিগ্ন। তবে জবরদস্ত প্রশাসক চন্দনাদির আদেশে সেখানেই ডাক্তারবদ্যিরা রীতিমতো মিছিল করে সুনীলকে হাসপাতালে নিয়ে গেলেন। আমরা অনুষ্ঠানের কথা তখন ভুলে গিয়েছি। বাকি অতিথিরাও রীতিমতো শংকিত। কিন্তু হাসপাতালে পৌঁছে তিনি ডাক্তারদের প্রয়াসে সাড়া দিতে লাগলেন। বিকেল পাঁচটার একটু জড়িত, ক্লান্তস্বরে বললেন, আমি কিন্তু অনুষ্ঠানে যাবো। সবাই তো উড়িয়েই দিলো। বিকেল ছটার সময় তিনি কিঞ্চিৎ দশরথনন্দন পানীয় প্রার্থনা করলেন। ভাবা যায়, সিসিইউয়ের রোগী। প্রার্থনা যথারীতি নামঞ্জুর হলো। তখন তিনি নিজেই ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলা শুরু করলেন। আশ্চর্য, সেই সব বাঘা বাঘা ডাক্তার ( বাঘা বাঘা বলেই হয়তো) রাজি হয়ে গেলেন রোগীকে অনুষ্ঠানে যাবার অনুমতি দিতে। বিজয়ী লেখক মাত্র আধঘন্টা দেরিতে মঞ্চে পৌঁছে সবার কবিতা শুনলেন, নিজের কবিতা পড়লেন এবং আয়োজকদের অনুরোধে শ্রোতাদের সঙ্গে সংলাপ বিনিময় করতেও রাজি হয়ে গেলেন। তখনই এ শর্মার সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ তাঁর কমলকুমার অবশেসন নিয়ে মজার কথাবাত্তাও হলো। লক্ষ্যনীয় একটু ক্লান্ত লাগলেও তাঁর স্পিরিট ছিলো মাশাল্লাহ। চুপি চুপি চন্দনাদিকে শুধোলুম, দশরথনন্দনের কী ব্যবস্থা হলো? তিনি বললেন, হয়ে গেছে , অলরেডি...
এরকম একজন ডোন্টকেয়ার মানুষের কাছেই মানুষের হৃদয়ের চিচিং ফাঁক মন্ত্রগুপ্তি লুকোনো থাকে। তাঁদের উদ্দীপনায় কখনও মরচে পড়ার লক্ষণ দেখা যায়না। তাঁরা যে ছেলেপুলেদের একেবারে ভিতরে ঢুকে তাদের সব কথাব্যথার কবিয়াল হয়ে যাবেন, তা আর আশ্চর্য কী?
---------------------
"....দিনগুলি কুড়োতে
কত কি তো হারালো।
ব্যথা কই সে ফলা-র
বিঁধেছে যা ধারালো !"
মনে পড়ে গেলো দিন কুড়োতে কুড়োতে আড্ডাঘরের দু'বছর পূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। দু'বছরের শিশু তো খ্যাপামির শীর্ষে থাকে। আর যে সত্যিকারের খ্যাপা হতে পারে, সে তো আর বুড়ো হয়না। সেই বাংলা লাইভ থেকে শুরু হয়েছিলো। কতো লোক এলেন, চলে গেলেন। কেউ টিকে গেলেন, কেউ ফিরে গেলেন। তবু কয়েকজন এখানে জমিজমা দখল করে কুঁড়েঘর বানিয়ে থেকেই গেলেন। গ্রামের নাম পাল্টালো কয়েকবার, তাতে আর কী? একটা প্রবণতা অবশ্য প্রবল হতে দেখেছি গত এক দশক। মূল আড্ডাধারীদের মধ্যে প্রবীণ ও প্রমীলাদেরই রাজপাট। হয়তো মজলিশি মেজাজটাই এর জন্য দায়ী। একটা ওল্ড ওয়র্ল্ড চার্ম, আত্মীয়তার স্বাচ্ছন্দ্য গুরুত্ব পেয়েছে সবার উপরে। যাঁরা তাতে স্বস্তিবোধ করেন না, তাঁদের উপস্থিতি বিরল হতে থেকেছে ক্রমশ। যদিও শরীরের বয়সে তরুণ তুর্কি নই, কিন্তু এ প্রসঙ্গে আমি সুনীলবাবুর আপ্তবাক্য পুরোপুরি মেনে চলি। আড্ডাঘরে আমি যে খুব নিয়মিত, তাও নয়। কিন্তু বেশক তার পিছনে কোনও ঔদাসীন্য নেই। অনেক লেখালেখিই রয়েছে আমার এই ভাঁড়ারে। উপভোগ করি মাঝে মাঝে আমাদের জমায়ত মোকাম কলকাতায়। এখন নাহয় এখানেই থাকি। কিন্তু যখন থাকতুম না, তখনও বহুদূর থেকে শুধু আড্ডা দিতেই কলকাতা আসতুম। হয়তো 'শুধু আড্ডার জন্য এই জন্ম' জাতীয় পাগলামিটা এক্সক্লুসিভ। যাঁরা এই সম্পর্কসূত্রটিকে মূল্যবান মনে করেন। আনন্দও পাই। যাঁরা নিয়মিত আসেন, লেখালেখি করেন, অনুরাগ-বিরাগ-সংরাগে জড়িয়ে থাকেন এবং যাঁরা এই আঙিনাটির পালনপোষণ করেন, সবাইয়ের জন্য উপলক্ষ্যটি তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করার একটি অবসর। ভালো লাগবে, যখন সবাই অকারণ দ্বিধা সংশয়কে পাত্তা না দিয়ে এখানে পাত পাড়বেন। সব রকম সেরিব্রাল স্বপ্ন আর ইডিয়টিক ইচ্ছে বোঝাই পানসিগুলো ভিড়িয়ে দেবেন এই ঘাটে। মোদ্দা কথা, যা নিয়ে শুরু করেছিলুম সেখানেই ফিরে আসি। নবীনপ্রজন্মকে যদি এই প্রয়াসে মিলিয়ে দিতে না পারি, তবে দীর্ঘজীবী হবার ইচ্ছে অপূর্ণ থেকে যাবে। জন্মদিন পালন সফল হবে যখন এই পাতায় কাঁচারা 'পেকে' উঠবেন সময়ের সঙ্গে, নিজেদের খুঁজে পাবেন আড্ডাঘরের নানা কর্মকাণ্ডের মধ্যে নিরঙ্কুশভাবে। প্রবীণরাও মনে রাখবেন কবির আপ্তবাক্যটি। খাপ পুরোনো হলেও হৃদয়ে কখনও জং ধরেনা।
অনেক দূরের বন আর দূরে থাকেনা। সেখানে রক্তিম অপরাহ্ন কখন জেগে ওঠে, কুসুমের মাস না বহ্নিতাপের জ্বালা, তার খবর পৌঁছে তারার ভাষায়। আমাদের তো তাও জানা দরকার। কী করে ভুলবো, হাওয়া বয় সন সন, তারারা কাঁপে। থামেনা কখনও । এই মূহুর্তে তো শুধু এইটুকুই চাওয়ার। আমাদের আড্ডার হৃদয়ে যেন মরচে না ধরে কখনও......
"....জেনে কী বা প্রয়োজন
অনেক দূরে বন
রাঙা হ'ল কুসুমে, না,
বহ্নিতাপে ?
হৃদয়ে মরচে-ধরা
পুরানো খাপে। "

ঝিনুক
শুভ জন্মদিন
“ভোরবেলাকার পাখির ডাকে প্রথম খেয়া এসে
ঠেকল যখন সব-প্রথমের চেনাশোনার দেশে ,
নামল ঘাটে যখন তারে সাজ রাখে নি ঢেকে ,
ছুটির আলো নগ্ন গায়ে লাগল আকাশ থেকে —
যেমন করে লাগে তরীর পালে ,
যেমন লাগে অশোক গাছের কচি পাতার ডালে ।
নাম ভোলা ফুল ফুটল ঘাসে ঘাসে
সেই প্রভাতের সহজ অবকাশে “…….
উমমম রোদে পিঠ দিয়ে সিঁড়িতে পা ঝুলিয়ে বসে আনতাবড়ি আকাশপাতাল ভাবছিল মেয়েটা। হাতে ঝালমুড়ি, কোলের ওপর একটা বই খোলা, কিন্তু দৃষ্টি অন্য কোনখানে। একটা ভোমরা একনাগাড়ে ঘ্যান ঘ্যান করেই যাচ্ছে ফুলগুলোর ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে, একবার লাল ফুলটা, তো পরমুহূর্তেই সাদা ফুলটা, তারপরেই মুখ বদলাতে কমলা পাল্টে আকাশনীল রঙে পৌঁছে যেতে বেশিক্ষণ লাগে না ভোমরাটার। আনমনে ভোমরাটাকে দেখতে দেখতে একগাল মুড়ি মুখে দেয় সে। উফফ বড্ড ঝাল লঙ্কাটাতে, হুসসস করতে করতে আবার একগাল মুড়ি, কচরমচর কচরমচর।
প্রায় নিঃশব্দেই ট্রেনটা এসে দাঁড়ায় সেই মুহূর্তে। ভিড়ভাট্টা নেই, বেশ খালি খালি, অল্প দু’একজন ছড়িয়ে ছিটিয়ে এই সীটে ঐ সীটে। এ জানালা, ও জানালায় উঁকি দিতে দিতে উঠেই পড়ে ট্রেনে কুতূহলী মেয়েটা। নাহ, এই ট্রেনের জন্য তার কোনরকম প্রতীক্ষা ছিল না। কোন ট্রেনের জন্যই কি ছিল? জানে না সে নিজেও। ট্রেন ছেড়ে দিল। যাহ, যাবে কোথায় ট্রেনটা? যাক না যেখানে খুশি, তার তো কোন গন্তব্য নেই, নেই কোথাও পৌঁছানোর কোন তাগিদ। গন্তব্যটা হয়তো গুরুত্বপূর্ণ, ঠিক জানা নেই তার। তার কাছে যাত্রাটাই সব, সেটাই আসল, পৌঁছে গেলে তো হয়েই গেল। সেইজন্যই বোধ হয় শুধু পথ চলাতেই তার আনন্দ।
জানালার পাশে একটা পছন্দসই সীট বেছে বসে পড়ল মেয়েটা। বইটা পাশের সীটে রেখে মন দিয়ে মুড়ি চিবাতে চিবাতে এইবার চারদিকে চোখ বুলায় সে। ওম্মা, সহযাত্রীরা তো প্রায় সকলেই মুখচেনা। সৌজন্যের হাসি হেসে হাত নাড়ে সে তাদের উদ্দেশ্যে। বাহ মন্দ নয় তো, নো বাংলিশ, না, বাংলিশ লাগছে না, দিব্যি সাদা বাংলাতেই কথা কওয়া যাচ্ছে সব্বার সাথে! পা তুলে গুছিয়ে আসনপিঁড়ি হয়ে বসলো সে এবার সীটের ওপর আরাম করে। ট্রেন চলতে থাকে ঝিকিঝিকি ঝিকিঝিকি করে। একটা করে স্টেশন আসে, ট্রেনের গতি মন্থর হতে থাকে, নতুন যাত্রীরা ওঠে। বেশির ভাগই চেনামুখ, বিগত কোন যাত্রায় দেখা হয়েছিল, কথা হয়েছিল, হয়তো কিছুটা চেনাও হয়েছিল, অথবা হয় নি। কেউ কেউ জানালা দিয়ে উঁকিঝুকি মেরে সরে দাঁড়ায়, কেউ উঠেও নেমে যায়, এ ট্রেন তাদের জন্য নয়।
ট্রেন আবার চলতে শুরু করে, কু-উ-উ-উ-উ, ঝুজ ঝুজ চিকা ঝিকা চিক্কা ঝিকা চিকা ঝিকা চিক্কা ঝিকা। সবাই ধীরে সুস্থে গুছিয়ে বসতে থাকে যে যার সীটে, কারো চোখে চশমা, কেউ গম্ভীর – রামগড়ুরের আতিথ্য আপ্যায়ন ছেড়ে সবে ফিরছে, কেউ উতলা, কেউ আনমনা, কেউ বড্ড সুখী, কেউ ভারি দুঃখী, কেউ একটু অতিরিক্ত রকমের ভালো, কেউ ভয়ানক পাজি, কেউ মহা সাবধানী, কেউ এলোমেলো, কেউ জমিদারের সাজে, কেউ ছেঁড়া জিনস পরে, কারো প্রত্যেকটা শব্দ নিক্তিতে ওজন করে বলা, কেউ খলবল, ছলছল করেই চলেছে। কেউ কেউ কাঁধের বোচকা নিয়ে হিমসিম নাজেহাল, কারো ঝোলাটি শান্তিনিকেতনি, কারো বোম্বাই বাক্স এতই বিশাল সে আর নীচে ওপরে কোথাও আঁটতে চায় না, সেই একটা কথা আছে না, ‘ছেলের চেয়ে ঘুনসি বড়’, কারো কারো মালমোট ঠিক তেমনি। তাই নিয়ে ঠোকাঠুকি পাশের লোকের সাথে, “কেন রে বেটা ইস্টুপিড, ঠেঙিয়ে তোরে করব ঢিট”। আশপাশ থেকে উল্লসিত উৎসাহ ভেসে আসে, “হয়ে যাক, হয়ে যাক, হাত থাকতে মুখে কেন”…. অন্যের খরচে আমোদ পাবার মত মজা আর কিচ্ছুটিতে আছে এই দুনিয়ায়? কাজেই সবাই দুই দলে ভাগ হয়ে এই খেলায় অংশ নেয়। মুহুর্মুহু ধেয়ে যায় শব্দবাণ, সেই কুরুক্ষেত্তর যুদ্ধের ব্রহ্মাস্ত্রের মত, তুমুল দ্বন্দ্বযুদ্ধ চলতে থাকে দুই পক্ষের মধ্যে, কোথায় লাগে ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান দ্বৈরথ!!
এরই মধ্যেই টুকটাক বিনিময় সহযাত্রীদের সাথে--- চা, কফি, বাদামভাজা, মুড়ি-চানাচুর, আলুচানা, পরোটা আর লাল লাল ডিমের ঝোল, কাচাগোল্লা, আইসক্রীম, সিগারেট, জর্দাপান। গল্প, গুজব, গুলতানি, এমনকি টপ্পা, গজল, রবিবাবুর গানও। জমে ওঠে চলমান মেহফিল। কেউ আবার কথাটি কয় না, শুধুই গান শুনিয়ে যায়, যন্ত্রসঙ্গীত। তবে বেশির ভাগ যাত্রীই দর্শকের ভূমিকায়। নিঃশব্দে চেয়ে থাকে তারা পলকহীন দুই চোখ মেলে। দু'একজন হকারও ওঠে মাঝে মাঝে নিজেদের পসরা নিয়ে। বহু গুণী মানুষের পায়ের ধুলো পড়ল ট্রেনে, আবার ঐ মেয়েটার মত নির্গুণ, নিকম্মা না-মানুষও দিব্যি গেঁড়ে বসেই রইল। সব ব্যাপারেই খুব নাক গলানোর বদভ্যাস ছিল কাণ্ডজ্ঞানরহিত মেয়েটার। ‘যেমন কর্ম তেমনি ফল’, একদম এই আপ্তবাক্য মেনেই সবাই মিলে বেশ করে ঝামা দিয়ে ঘষে দিয়েছে লম্বা নাকটা তার কয়েকবার। বেশ হয়েছে। কয়েক দফা ঝামা ঘষার পরে এখন কান মলে নিজের নাক নিজের কাছেই রাখতে চেষ্টা করছে সে আপাতত।
খবরের কাগজ ভাগ করে পড়া হয়। তারপর তরজা, রাজনীতি থেকে ক্রিকেটের ম্যাচ ফিক্সিং, সানিয়া মির্জা থেকে সানি লেওনি ..... কি নেই তরজার বিষয়বস্তুতে! ইউ এস প্রেসিডেন্ট আর বাবুর বাড়ির উঠোন ঝাড় দেওয়া তারক দুজনেই একাসনে পাশাপাশি। সি বি আই তদন্ত থেকে শুরু করে বাবা রামদেবের সাফল্যের গোপন কথা কোনটাই ততটা আর গোপন থাকে না। খবরের কাগজ থাকবে আর জিরাফ বা ধর্ম থাকবে না, তা কি করে হয়? তা কেউ ধর্মে থাকে তো কেউ জিরাফে, কারো আবার দুয়েতেই অনায়াস গতায়াত, কারো হাল ‘শ্যাম রাখি না কুল রাখি’, একবার ধর্ম তো আর একবার জিরাফের নাগরদোলায়। হল্লা-গুল্লা, সারা পথ গুলজার। প্রেম থেকে ভূত, কবিতা থেকে পাঁচফোড়ন, ফুল থেকে পেঁচা….. উত্তাল তর্কবিতর্কে জমে ওঠে যাত্রা ---- ঝমঝ্মিয়ে যখন বৃষ্টি নামে বাইরের আকাশে, সব মতবিভেদ এক লহমায় ভেসে চলে যায় বৃষ্টির দরদী জলে, জানালার কাচ নামিয়ে সবাই মিলে সমস্বরে গরম গরম খিচুড়ির কথা ভাবতে শুরু করে একই সাথে। খিচুড়ি আর বেগুনির মরমী ভাবনায় এক হয়ে যায় পক্ষে-বিপক্ষের যত মতামত।
আবার রোদ ওঠে। জানালার বাইরে ছুটে চলে জীবনের মধুমাসের কুসুম ছিঁড়ে গাঁথা মালার কাহিনী থেকে উঠে আসা গ্রাম, ইঁটের পাঁজরে লোহার খাঁচায় তৈরী একটার পর একটা শহর, পদ্মদীঘির ঘাট, কদমতলার মাঠ, আলতা পায়ের আলতো ছোঁয়া মাখা আলপথ, বাঁশের সাঁকোটি শিশুশিল্পীর আঁকা, হেলানো বটের গায়ে দোল খাওয়া ছুটি, কাক-চিল-শালিকের মধুবৃন্দাবন ইলেকট্রিকের পোস্টগুলো। মাঝে মাঝে পাশ দিয়ে গুমগুম করে বেরিয়ে যায় এক্সপ্রেস ট্রেন। তার জানালা দিয়ে কেউ হয়তো চেয়ে দেখে তাচ্ছিল্য ভরে ঢিমে তেতালা ট্রেনটার পানে। জানালা গলে ভেসে আসে দু’এক কলি, “দিলওয়ালে কো সীট মিলে ইহা টিকেট কা কোই কাম নহি”….. যে যার মর্জিমত শুয়ে গড়িয়ে ঘুমিয়ে নেয়, হাই তোলে, বিশ্রাম করে, জেগে থাকে শুধু ড্রাইভার আর কণ্ডাকটর, তাদের সুচারু পরিচালনায় ঝিকঝিক করতে করতে স্টেশনের পর স্টেশন পেরিয়ে যেতে থাকে ট্রেনটা নিশ্চিন্তে, চাকায় চাকায় বাজতে থাকে…..”ইয়ে তো চলেগি, চলতি রহেগি”...... ঝু-উ-উ-উ-উ-ম, ঝুমাঝুম ঝুমঝুম, ”ইয়ে তো চলেগি, চলতি রহেগি”......
সকাল-দুপুর-রাত পেরিয়ে, গ্রীষ্ম-বর্ষা-শীত ভেঙে ছুটে চলে ট্রেন, সময়ের সমতল উজিয়ে জীবনের পাকদণ্ডীতে কখনো খাড়াই কখনো গড়াই বেয়ে ধীরে সুস্থে, চলতে থাকে চলতেই থাকে দূরের দিগন্তের পানে, সেই যেখানে আকাশ উবু হয়ে চুমু খাচ্ছে মাটিকে, একটি আহ্নিক মুহূর্ত থেকে আরেকটিতে, এক জন্মদিন থেকে আর এক জন্মদিনে......
জন্মদিন আসে বারে বারে
মনে করাবারে—
এ জীবন নিত্যই নূতন
প্রতি প্রাতে আলোকিত
পুলকিত
দিনের মতন।

জল
আজি জন্মদিনে
আজ আড্ডার আরও একটা জন্মদিন|
টলমল পায়ে হাঁটতে হাঁটতে পেরিয়ে এল আমাদের প্রিয় আড্ডা আরও একটা বছর| সেদিনের সেই জৌলুসহীন পাতা আজ অনেক চকচকে‚ ঝকমকে| ঢুকলেই আর মনে হয় না কোন ভরা বর্ষার স্যাঁতসেঁতে ভিজে আড্ডার ঠেক| বরং ঢুকলেই চোখ ধাঁধিঁয়ে যায় তার সাজ-বাহার দেখে| আধুনিকতার সাথে তাল মিলিয়ে এখন সে অনেক পরিণত| আমরা গুটিকয় যাদের কাছে এই আড্ডা যেন আড্ডা মারার পীঠস্থান‚ রোজকার ভাত হজম হতে চায় না এই পীঠস্থানে না এলে‚ তারা ছাড়াও আরও নতুন নতুন মানুষ এই আড্ডায় নিয়মিত আসুন সেই লক্ষ্য নিয়ে নিরন্তর কাজ চলছে| নিরলস প্রয়াস চলছে এই আড্ডাকে সর্বজনগ্রাহ্য করে তোলার| এই প্রয়াস নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবী রাখে|
শুরু হয়েছিল একধরনের অনিশ্চয়তা নিয়ে| সবাই আসবে তো এই আড্ডাঘরে? আমরা যারা এসেছিলাম তাদের মনের কোণেও কি আঁচড় কাটেনি এই আশঙ্কা| আজ কিন্তু সেই আশঙ্কা অনেকাংশেই কেটে গেছে| আড্ডার টানে আপনকাকুর ডাকে সাড়া দিয়ে মুনিয়া‚ ঝিনুক‚ হিমু‚ স্তুতিদি‚ চঞ্চলদা ‚ মণিদি‚ ডালিয়াদি‚ তৃপ্তি‚ বাসুদা‚ সোমা‚ মনোজদা‚ শিবাংশুদা‚ প্রবুদ্ধ‚ অরিন্দম চক্রবর্তী প্রমুখ আড্ডাধারীরা এসেছে| তাদের কলমের আঁচড়ে পরিপূর্ণতা দেবার আন্তরিক চেষ্টা করেছে এই পাতাকে| আবার এই আড্ডা দিতে দিতেই কখন যেন মান-অভিমানে কেউ কেউ ছেড়ে চলে গেছে আড্ডাকে| কিন্তু আড্ডা তো থেমে থাকেনি‚ আর দৃঢ় বিশ্বাস থেমে থাকবেও না| হ্যাঁ এমন তো হয়‚ যে কোন কোনদিন একটাও লেখা পড়ে না আড্ডার সাদা পাতায়‚ সময়াভাব‚ ইচ্ছের অভাব কিম্বা অন্য কোন কারণে| তখন যে খারাপ লাগা আসে না তা নয়‚ তবু জানি আড্ডা নিজের গতিতে‚ নিজের পথে বয়ে চলে‚ চলবেও|
এই আড্ডার টানেই তো আলাপ হয়েছে শাল্মলী‚ ভোঁদরদা‚ মানব‚ ঝরাপাতাদির সাথে| আড্ডার পাতাতেই তো প্রথম পড়েছি অলকাদির লেখা| লেখার মাধ্যমেই তো আলাপ আর সে আলাপ গন্ডী ছাড়িয়ে আজ মায়ার বন্ধনে আবদ্ধ| এই পাতাকে অনেকেই বলে মায়াপাতা| খুব ভুল বলে না‚ মায়ার বন্ধনেই যেন আমরা পরস্পরের সাথে আত্মীয়তা বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছি| কোন একজনের দীর্ঘ অনুপস্থিতি আমাদের চিন্তা - উদ্বেগকে বাড়িয়ে তোলে| আবার তার ফিরে আসা যেন এক দীর্ঘ উদ্বেগের ইতি ঘটায়| আমরা একজন‚ অন্যজনের দুঃখে‚ প্রিয়জনের বিচ্ছেদে শারীরিক নয় মানসিকভাবে পাশে‚ কাছে‚ সাথে থাকার চেষ্টা করি| এমন পাতা আর কোথায় আছে| এ একমাত্র আড্ডাতেই সম্ভব|
আড্ডার জন্মদিনে আড্ডাকে অনেক অনেক শুভেচ্ছা| আমাদের প্রিয় আড্ডা আরও সুন্দর হয়ে উঠুক| পুষ্পায়িত হয়ে উঠুক দিনে দিনে| যারা অতিথি হয়ে আসেন‚ তারাও নিশয়ই ভালোবাসেন আড্ডাকে| তারাও একদিন অতিথির আসন ছেড়ে আড্ডাধারীর আসন অলঙ্কৃত করবেন আশা রাখি|
শুভ জন্মদিন আড্ডা!!!!!

অপন
জন্মদিনে বন্ধুদের শুভেচ্ছাবার্তা
আড্ডার স্পনসর এবং তার চেয়েও বড় পরিচয় আমাদের অভিবাবক অপন বসু পাঠালেন সবার জন্য শুভেচ্ছা বার্তা| সঙ্গে রয়েছে স্তুতি‚ মুনিয়া ‚দীপঙ্কর বসু‚ ঝিনুক এবং মানবের শুভেচ্ছা বার্তাও|