তা হলে এক বছর হয়েই গেলো। বাংলা আড্ডার ক্যালেন্ডারে পাতা বদল। মজলিশ থেকে বাংলা আড্ডায় কায়াপলট। কাঁঠালকাঠের চৌকি বদলে হয়েছে খাট/ কুঁড়ে ঘরের দরজা সরে জোড়া কপাট....
---------------------------------------
একটা সময় ছিলো, যখন আমরা আমাদের শ্রেষ্ঠ আড্ডাগুলি দিতুম মাঠে ময়দানে, রকে গলির মোড়ে। সঙ্গে যদি কিছু চা তেলেভাজার সঙ্গত থাকতো তবে তো স্বর্গসুখ। এই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ নিকৃষ্ট সব প্রসঙ্গ মুখরিত তুমুল উচ্চকিত আড্ডা থেকে আমরা যেভাবে বেঁচে থাকার অনন্ত রসদ সংগ্রহ করেছি তার কোনও বিকল্প কখনও পাইনি। সেই সব আড্ডাধারীরা কখন আমাদের ব্যক্তিঅস্তিত্বের অংশ হয়ে গেছে তার কোনও পোষাকি খতিয়ান কোথাও লিখে রাখতে হয়নি। সেই সব আড্ডার বিষয়বস্তু হিসেবে জগৎ সংসারের যাবতীয় প্রসঙ্গই আসতো, কোনও ভেদরেখাবিহীন সামূহিক মনোকর্ষণ। সমস্ত আড্ডাধারীরাই তাদের ধারণা, যুক্তিবোধ, কল্পনা ও সৃষ্টিশীলতার যেসব শ্রেষ্ঠ প্রকাশ, তাকে উজাড় করে দেওয়ার প্রয়াস করতো। বিষয়গুলি ব্যক্তি থেকে শুরু হয়ে সমষ্টির অনন্ত সম্ভাবনায় পৌঁছে যেতো। যেমন জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রের মধুবংশীর গলি বা বিষ্ণু দের অন্বিষ্ট। আমাদের আড্ডা ছিলো সেরকম।
------------------------------------
আজ আমরা আড্ডা দিই পরস্পরের ড্রইংরুমে বসে। একজন গৃহকর্তা ও তাঁর অভ্যাগতরা আড্ডা দেবার চেষ্টা করি হয়তো, কিন্তু আলোচনাগুলি হয় ছাড়া ছাড়া, পারম্পর্যবিহীন, নিরুৎসাহ, অগভীর। গৃহকর্তার পরিবেশিত সুখাদ্যের ঘ্রাণ বা ভাগ্য ভালো হলে সিঙ্গল মল্টও আমাদের মাঠ ময়দানের আড্ডার প্রখর নিবিড়তাকে ফিরিয়ে আনতে পারেনা। সেইসব আসরেও ফেসবুক টুইটারের কালো ছায়া ডানা মেলে নেমে আসে। সবাই এখন স্মার্ট ওয়ান লাইনারের ভক্ত ও ভৃত্য। নিজের হৃদয়ের কাছে যাবার শ্রম স্বীকার করতে প্রস্তুত নই। একমাত্র ভাবনা কীভাবে নিজের একটা 'স্মার্ট' ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠা করা যায়। কীভাবে বেচা যায় নিজেকে। আমাদের মতো এলেবেলে ঢিলেঢালা লোকেরা, যারা কিছু পেতে বা কিছু দিতে আড্ডায় আসে তারা অনিঃশেষ ধন্দে পড়ে নীরবতা স্বর্ণিম শান্তিকল্যাণের আশ্রয় নেয়।
তবু 'আড্ডা' দিই, কারণ তা আমাদের ভবিতব্য। তাই বছর ঘোরে অলীক পাতার আশ্রয়ে।
-----------------------------------
আমি যখন প্রথম বাংলা আড্ডায় আসি তখন মূল পাতা ছিলো আমাদের মাঠময়দান রকরাস্তার আড্ডা। এখনও তাই আছে। তারপর ড্রইংরুমের সীমাবদ্ধ আকাশে একের পর এক তারা ফুটিয়েছেন গৃহকর্তারা। তাঁদের বহু পরিশ্রম করে এনে দেওয়া আয়োজন ব্যপ্তির সীমা এগিয়ে দিয়েছে বহুদূর। বহু আগ্রহীজন এখন ইচ্ছেমতো সেই সিঙ্গল মল্টের আসর পর্যন্ত পৌঁছে যান, বিনা আয়াসে। শারদীয় বা নববর্ষের বিশেষ সংখ্যা তো সত্যিই 'বিশেষ' হয়ে উঠেছে। নিজেকে বদলে নেওয়া, নতুন ভাবে ফিরে পাবার আকাঙ্খা, আজ আমরা এই পাতায় খুঁজে পাচ্ছি। কারণ যেকোনও পরিবর্তনই স্বাগত। বেদান্তে সেটাই ব্রহ্ম এবং দাস ক্যাপিটালে তা 'সত্য'।
--------------------------------
সালতামামি করতে গিয়ে দেখছি গত এক বছর ধরে যাঁরা সেই সব আলোচনায় (পড়ুন আড্ডায়) এসেছেন, তাঁরা নিজের কথা পেশ করার আগে যথেষ্ট মনোসংযোগ করেছেন। নিজের প্রকাশভঙ্গির শ্রেষ্ঠ শৈলিটি উপহার দেবার প্রয়াস করেছেন। এভাবেই তো একের কথা অনেকের হয়ে ওঠে। যাঁরা 'নীপা' তাঁরাও উপভোগ করেন পুরো মাত্রায়। দায়হীন উড়ো মন্তব্যের চাপ এখন অনেক কম। অগভীর, নিরাসক্ত, পল্লবগ্রাহী চর্চা থেকে দূরে থাকার সচেতন উদ্যম স্পষ্ট হয়েছে এই এক বছরে। -----------------------------------
নানা কারণে ব্যক্তি আমার কিছু দ্বিধা ছিলো প্রথম পর্বে। কিন্তু পরিচালকদের নিষ্ঠা ও শ্রমের যে উদাহরণ দেখলুম গত বারোমাসে, তাকে দাদ দিতেই হয়। হয়তো তাঁরা মাঝে মধ্যে একটু নিরাশ হয়ে পড়েন। ভাবেন 'আড্ডা'ধারীদের উৎসাহ তাঁদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারছে না। কিন্তু ব্যাপারটা সম্পূর্ণ সত্য নয়। এখানে নিয়মিত আগন্তুকদের মধ্যে সাবেকি মজলিশের দৌলতে যে পরস্পর ব্যক্তিক সম্পর্কসূত্র তৈরি হয়েছিলো, তাতে আরো শান চড়েছে। অন্য সব পাতাগুলির সঙ্গে তুলনায় এখানে নৈর্ব্যক্তিকতার সাহেবিয়ানাকে বেশ এড়িয়ে চলা হয়। এটা এই পাতার একটা প্রধান আকর্ষণ। 'আড্ডা' এবং সেমিনারমার্কা মগজ ব্যায়াম, দুই ভিন্ন মেরুর রসদে কখনও খামতি পড়েনা। আড্ডায় মানুষ তার যাবতীয় বোকামি, কান্ডজ্ঞান, রসবোধ, সুখদুঃখের পশরা নিয়ে সমমনা, সহমর্মী বন্ধুদের সঙ্গে নিজেকে বিনিময় করে। এর মূল্য কিছু কম নয়। আমার বিশ্বাস পরিচালকদের 'স্বপ্নে'র লক্ষ্যমাত্রা নিশ্চয় পূর্ণ হবে। কিন্তু সন্ত কবিরকে কী করে ভুলি। " ধীরে ধীরে রে মনওয়া, ধীরে সব কুছ হোয়/ মালি সিঁচে সও ঘড়া, রিত আওয়ে ফল হোয়।"
-----------------------
পরিশেষে এটাও লিখে রাখি। যদিও বেশ কিছু সৃজনশীল সুহৃদের নিরন্তর যোগদানে এই পাতাটির শ্রী ও সৌষ্ঠব ক্রমশঃ উন্নত হয়েছে, কিন্তু যে দুজন এই উদ্যমটিকে সফলতার সিঁড়ির দিকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন, তাঁদের নিরলস শ্রম ও নিষ্ঠার উল্লেখ করাটা আমার মনে হয় অবশ্য কৃত্য। অরিন্দম রায় এবং শ্রী'কে এই অবসরে অভিনন্দন জানাই। তাঁদের সাময়িক সাঁঝস্বভাবের দ্বিধা দূর হোক। সবাইকে নিয়ে বাংলা-আড্ডা আগামী বার্ষিক গতির কক্ষপথকে অতিক্রম করুক, সেই শুভেচ্ছা রেখে গেলাম।