ঠক ঠক|
কাকু সামনের ঘরেই শুয়েছিলেন| সবে চোখটা একটু লেগে এসেছিলো| দিবানিদ্রা‚ বাংলায় যাকে শিয়েস্তা বলে‚ সেসবের অভ্যেস কাকুর কোনোদিনই নেই| তবে আজি প্রভাতে কাকিমা ধ্রুপদী সঙ্গীতের সিডি চালায়েছিলেন‚ তাতে এখনো সেই রবিবাবুর শিহরে তরুলতার মতো কাকুরও অন্ত:করণ মাঝে মাঝে শিউড়ে উঠছে| তাই সোফাতেই একটু লম্বা হয়েছিলেন|
আলস্য ভেঙ্গে দরজা খুলে দেখেন গোটা ছয়সাতেক ষন্ডাগুন্ডা যুবক বেশ ভদ্রভাবে দাঁড়িয়ে আছে| সামনের মোটাসোটা ছেলেটি‚ নাম বুদ্ধু‚ নিজেকে বেশ স্মার্ট ভাবে‚ অনেক কথা গুছিয়ে এনেছিলো‚ হটাৎ সামনে সৌম্যদর্শন কাকুকে দেখে একটু ঘেঁটে যায়| তবু জেল লাগানো চুলে হাত চালিয়ে ভেজা হাত ধেৎ বলে প্যান্টে মুছে চিনিমাখানো গলায় বলে‚ ---ইয়ে মেসোমসায়‚ আমরা বালানগর থেকে আসচি স্যার| আমাদের লীডার আলুদা‚ ঐ ওদিকে একটু পার্সোন্যাল কাজ সেরেই আসচে‚ উনি আপানার সাথে একটু মশলা কর্বেন| হে হে|
কাকু বুঝতে পারেন না এই দুপুরে এতগুলি বেপাড়ার ছেলে মশলা চাইতে হঠাৎ ওঁর বাড়ী কেন এলো| ততক্ষণে সিগারেটটা নিভিয়ে আলু নামের লম্বা একটি যুবক‚ দেখতে বেশ সম্ভ্রান্ত‚ সীনে চলে এসেছে| এসেই বুদ্ধুকে সামনে দেখে কেস গেজে নেয় (gauge করে নেয়)‚ আর বুদ্ধুকে এক কাঞ্চাপাটি মেরে সাইড করে দেয়| তারপর একটু গলা খাঁকরে বলে‚ ইয়ে কাকু একটু বসা যাবে?
--হ্যাঁ হ্যাঁ এসো না সবাই|
সবাই আসে| কাকু লক্ষ্য করেন শুধু যুবক নয়‚ হলুদ জীনস পরা এক যুবতীও আছেন দলে‚ যিনি সোফায় গুছিয়ে বসেই একখানি সেলফি নেন‚ মুখখানি অকারণেই হাসি হাসি করে| কাকু তাকেই আগে বলেন‚
---মামণি তুমি জলটল কিছু খাবে? রোদে ঘুরছো মনে হয়
মামণি! বুদ্ধুর চৈনিক চক্ষুদ্বয় বিস্ফারিত হয়‚ আর একটু হলেই বিকট শব্দে হেসে উঠতো‚ কোনোরকমে সামলায়| মামণিও একটু লজ্জা পেলেন বোধয়‚ না না বলে ঘাড় বেঁকিয়ে একটু জড়োসড় হয়ে বসেন| অন্তরের তেজ কিছুক্ষণের জন্য বক্সড আপ থাকে|
--হ্যাঁ বলো এবার বাবাসকল‚ কি ব্যাপার|
আলুই মুখ খোলে| লেখাপড়া জানা ছেলে‚ নামের শেষে দম ছিলো‚ স্বাভাবিক নিয়মে আলুরদম‚ তার থেকে আলু‚ তার থেকে আলুদা|
কথা বলতে গিয়ে আলুর সম্ভ্রান্ত মুখখানি হঠাৎ আরশুলার মতো করুণ হয়ে যায়| একটু ভেবে বলে‚ --বুঝলেন কাকু‚ বালানগরের সাথে একটু কিচাইন হয়ে গেছে| (কাকু শব্দটা নোট করেন| মানে না বুঝলেও বেশ প্রেমাস্পদ কোনো অর্থ নেই সেটা বুঝলেন| পরে কাকিমাকে জিগ্যেস করে নেবেন)
তো কেসটা হলো‚ ওখানে কিছু ধারালো পাব্লিক অছে‚ আমাদের বিসেস প্লেস হতে দিচ্ছে না| ঠেকেও সেকেন্ড বেঞ্চে বসিয়ে রাখে‚ মোন খুলে কতাই বলা যায় না মেসোমসায় (কাকু থেকে মেশোমশাই|)
সমস্যাটা গম্ভীর‚ সেটা মেশোমশাই‚ মানে কাকু বুঝতে পারেন| কিন্তু তিনি কি করে এর সমাধান করবেন সেটা.....
----আমরা একটা ক্লাব খুলবো কাকু| (মেশোমশাই থেকে কাকু)| আপ্নি তো বিল্ডিং লাইনের লোক (কাকু বড়ো ইঞ্জিনীয়ার)‚ ঘরটার একটা ডিজাইন করেছি একবারটি যদি দেকে দিতেন স্যার (কাকু থেকে এবার স্যার)
যাক‚ অল্পের ওপর দিয়েই যাবে মনে হয়‚ এই ভেবে কাকু বলেন তা বেশ তো‚ দেখি কি ভেবেছো|
---আ--আপ্নাকে বেসি কিছু লোড নিতে হবে না কাকু‚ সুধু এই ওপর-ওপর একটু দেকে দেবেন| এই এ বললো (মামুনির দিকে দেখিয়ে বলে) বিল্ডিংটা বেশ ঝিঙ্কু হওয়া চাই নইলে পাব্লিকে ভাও দেবে না‚ ক্লাবঘরের সামনে ট্রাফিক জ্যাম হওয়া চাই| তাই এলাম মেসোমসাই (আবার কাকু থেকে মেশোমশাই)
কাকু কিছু বলেন নিজের মতো করে| তা আলুর আবার সবেতেই একটু টিকটিক করা স্বভাব‚ একটু খুঁতখুঁত করে বলে‚ না কাকু| আমার বলে কিনা কতো ইচ্ছে ডানদিকে বাঁদিকে কিছু করি তা আপ্নি তো স্যার চার্দিক ক্যামোন ঘিরেঘিরে দিচ্ছেন (না-চিবো ঘিরিঘিরি নাকি‚ কাকু মনে মনে হাসেন)|
----ক্লাবঘর তো নিজেদের আড্ডা দেওয়ার জায়গা বাবারা| এতো ঝকমক করে কি হবে? এ তো আর বিয়েবাড়ী নয়|
বুদ্ধুর এতোক্ষণ বসে থাকার অভ্যেস নেই| হঠাৎ গাঝাড়া দিয়ে উঠে বলে‚ তা কেউ বিলা করলে তার বাপের বিয়ের সার্ভিসও চালু কর্তে পারি
কথা শেষ না হতেই আবার এক থাবড়া| আলুর সামনে বুদ্ধু আবার বেশী খাপ খোলে না| চুপ করে বসে যায়|
কথাবার্তা আরো চলতো| এমন সময় পর্দা সরিয়ে কাকিমার প্রবেশ| চিন্তিত মুখ‚ কিন্তু কি তেজ আর লাবণ্য‚ সরু ফ্রেমের চশমার পেছনে চোখের কি দীপ্তি| ঘরে ঢুকেই এতোজনকে দেখে একটু থতমত খেয়ে যান| তারপর বলেন‚ ও মা এতগুলি ছেলেমেয়েকে এইভাবে বসিয়ে রেখেছো? ওরে তোরা এখানেই বিকেলের জলখাবার খেয়ে যাস|
সে আওয়াজে কি ছিলো‚ ছেলেমেয়েগুলি আইসক্রীমের মতো গলে যায়| তবু আলু টিকটিক করে‚ না না থাকি মাসিমা‚ আপনাকে দেখে বেস টায়ার্ড লাগছে|
বুদ্ধু খাওয়ার কথায় প্রবল উত্তেজিত হয়ে পড়ে‚ বলে আরে আলুদা তুমি সেলোটেপ লাগাও তো বেসি মটকা গরম কোরো না| না না মাসিমা আমরা সব খেয়েই যাবো|
কাকুর স্ত্রী মাসিমা কিন্তু সত্যি ক্লান্ত ছিলেন| বুদ্ধুকে দেখে সরল সাদাসিধা লাগায় তার দিকেই তাকিয়ে বলেন‚ আসলে বাবা‚ চিন্তার কারণ আছে| তোমাদের এক পিসিমা এসেছেন আজ বাড়ীতে‚ একটু ছিটিয়াল| বলছে বাগান থেকে এক মানুষ সমান এক কলাগাছ তুলে নিয়ে যাবে‚ বাড়ীতে তাতে কুমড়ো ফলাবে| আচ্ছা তুমিই বলো বাবা‚ এ কি পাগলামি| ----আরে কোনো প্রব নেই কাকিমা (মাসিমা থেকে কাকিমা)‚ আমি ঐ সব ছিটিয়াল কেস অনেক টেকাপ করেছি| আপ্নি সুধু উনাকে আমার ফ্রন্টে বসিয়ে দিন আমি সব সেট করে দিচ্ছি| কাল থেকে কলাগাছ দেখে চিনতেও পারবে না সেরকম ওসুদ দিয়ে দেবো দুডোজ|
বুদ্ধু এটুকু বলেছে কি বলেনি‚ ভীমবেগে পর্দার পেছন থেকে উলের গ্লাভস পরা এক রমণী ধাঁ করে তেড়ে এসে বুদ্ধুর থ্যাবড়া নাকে ধড়াম করে এক মাকালী ১০০ নং দেশী সাইজের পাঞ্চ ল্যান্ড করে দেন| বোধয় পর্দার আড়াল থেকে শুনছিলেন‚ বুদ্ধুর প্রগলভতা সহ্য করতে পারেন নি| বুদ্ধু দু মিনিট বোধিবৃক্ষের ওপর শাখামৃগের মতো বসে থাকে‚ তারপর "কাকিমাআআ" বলে রণভুমিতে লুটিয়ে পড়ে|
গোলযোগের আভাস পেয়ে রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে সাদা চুলের পড়শী দাদা বিড়বিড় করে "গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব‚ গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব" বলে দ্রুত দিগন্তের দিকে বিলীন হন| আর পাশের বাড়ীর মণিমাসিমা হাসি হাসি মুখে জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে জিগ্যেস করেন‚ হ্যাঁ গা তোমাদের বাড়ী কি আজ কারুর জন্মদিন?